সচলের আড়ালে অচল গাবতলী বাস টার্মিনাল

গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি বেশির ভাগ দূরপাল্লার বাস। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি বেশির ভাগ দূরপাল্লার বাস। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

‘আজ বেচাকেনা করুম না। বাস চলে না। স্টাফরা বাকি খাইবে। এমনিই বেচাকেনা নাই। বাকি দিয়া লস বাড়াইমু না’—কথাগুলো বলছিলেন স্বপন মালাকার নামের এক হকার। রাজধানীর গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে সিগারেট, চকলেট, জুস, খাবার পানি বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন সকাল সাতটায় বিক্রি শুরু করেন ষাটোর্ধ্ব স্বপন। রাত ১২টার দিকে বিক্রিবাট্টা শেষ করেন। দিন শেষে গড়ে বিক্রি হয় প্রায় চার হাজার টাকা, লাভ হয় ছয় শ টাকার মতো। কিন্তু আজ বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত স্বপন বিক্রি করেছেন মাত্র নয় শ টাকা। কারণ জানতে চাইলে স্বপন বলেন, গাবতলী টার্মিনালে দুদিন ধরে বাস ছাড়েই না। দু–একটা বাস ছাড়লেও শ্রমিকেরা রাস্তায় বাধা দেন। তাই যাত্রী কম আসছে। যাত্রী কম থাকলে বেচাকেনাও কম হয়।

গাবতলী বাস টার্মিনালে বাস ও যাত্রীর আসা-যাওয়া কমে গেছে গতকাল মঙ্গলবার থেকে। টার্মিনালের ভেতরে অসংখ্য বাস অলস দাঁড়িয়ে আছে। বাস না চললেও টার্মিনালের প্রতিটি কাউন্টার খোলা। থেমে নেই টিকিট বিক্রেতাদের হাঁকডাকও। এই হাঁকডাকেই সচল ভাবটা ধরে রেখেছে গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল এলাকা।

কাউন্টারগুলো খোলা থাকলেও যাত্রী যাঁরা আসছেন, তাঁরা নির্ধারিত সময়ের বাসের টিকিট পাচ্ছেন না। কথা হয় যাত্রী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। স্ত্রী ও দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি যাবেন মাদারীপুরে। সপরিবার রফিকুল ইসলাম টার্মিনালে এসেছেন বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। সার্বিক পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কিনতে যান তিনি। টিকিটে বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময় লেখা বিকেল চারটা। বেলা একটার দিকে রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সার্বিক পরিবহনের বাস ছাড়ে এক ঘণ্টা পরপর। কিন্তু আজ এখানে অন্য নিয়ম। বাস আছে ভেতরে। অথচ ছাড়বে বিকেল চারটায়। চার ঘণ্টা অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’

চিকিৎসা শেষে মাগুরা ফিরবেন অসুস্থ ফজলু কাজী ও তাঁর স্ত্রী। দুই ঘণ্টা বসে থেকেও পাননি টিকিট। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
চিকিৎসা শেষে মাগুরা ফিরবেন অসুস্থ ফজলু কাজী ও তাঁর স্ত্রী। দুই ঘণ্টা বসে থেকেও পাননি টিকিট। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

একই অবস্থা বরিশালের যাত্রী তন্ময় বোসের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গৌরনদীগামী হানিফ পরিবহনের দুপুর সাড়ে ১২টার টিকিট কিনেছি। পৌনে দুইটা পর্যন্ত বাসের কোনো খবর নেই।’ আরেক যাত্রী শেখ নাজমুল ইসলাম বললেন, তিনি ফরিদপুর যাবেন। গাবতলী থেকে আধা ঘণ্টা পরপর সূর্যমুখী পরিবহনের বাস ছাড়ে। সাড়ে ১১টায় কাউন্টারে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত বেলা দুইটার একটি বাসের টিকিট পেয়েছেন। বাস ঠিক সময়ে ছাড়বে কি না, সেটি নিয়েও চিন্তায় আছেন।

বাস না চলায় বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীরা। সারওয়ার হোসেন নামের এক পরীক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামীকাল সকালে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু গাবতলী টার্মিনালে এসে কোনো বাস পাচ্ছি না। কাউন্টারগুলো থেকেও কিছু জানানো হচ্ছে না।’

যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সূর্যমুখী পরিবহনের ব্যবস্থাপক সানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাস কম ছাড়া হচ্ছে, তাই সময় ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাস মালিক সমিতির এক নেতা জানান, সারা দেশের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা আগামীকাল ঢাকায় আসবেন। আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দুপুরে বাসের টিকিট কিনেও বিকেল পর্যন্ত বাসের দেখা পায়নি এই পরিবার। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
দুপুরে বাসের টিকিট কিনেও বিকেল পর্যন্ত বাসের দেখা পায়নি এই পরিবার। গাবতলী, ঢাকা, ২০ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

বাসমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় জড়িত চালককে জামিন না দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত ওই চালককে দীর্ঘ সময় কারাবন্দী থাকতে হবে। জামিন না দেওয়ার বিধান বাতিলের দাবি করছেন চালকেরা। চালকদের এই দাবির প্রতি বাস-ট্রাকমালিকদের সমর্থন রয়েছে। তবে তাঁরা কেউই প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন না। কৌশল হিসেবে বাসের ট্রিপ কমিয়ে দেওয়া হলেও কাউন্টারগুলো খোলা রাখা হয়েছে। যাত্রী এলে তাঁদের ফিরিয়েও দেওয়া হচ্ছে না। টিকিট দেওয়া হলেও বাস ছাড়ছে কয়েক ঘণ্টা পরপর।

গাবতলী টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সকালে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন রুটে কয়েক শ বাস ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। তবে ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০।

গাবতলীর ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার জাহিদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, টার্মিনাল সচল আছে, কিন্তু বাস অন্য দিনের তুলনায় কম ছাড়ছে। কম ছাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।