চার কমিশনারের মত না নিয়ে ইসিতে কর্মচারী নিয়োগ

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের একটি নিয়োগ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে অন্য চার নির্বাচন কমিশনারের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। চার কমিশনারের কোনো মত না নিয়েই ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ চূড়ান্ত করায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী গতকাল রোববার সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, চার কমিশনারকে আর্থিক বিষয়সহ অনেক বিষয়ে জানানো হয় না। বর্তমান অবস্থায় ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তাঁরা শুধু সিইসি ও সচিবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। নিয়োগের বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে সিইসি ও সচিব মনে করেন, নিয়োগসহ কিছু বিষয় ইসির এখতিয়ারের বাইরে। এটি সচিবালয়ের দায়িত্ব। সচিব সিইসির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন। সচিবালয়ের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে এর আগেও চার কমিশনারের সঙ্গে সিইসির বিরোধ দেখা গিয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি সচিবালয়ের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে ১২তম থেকে ২০তম গ্রেডের ১০টি পদে ৩৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি সচিবালয়। এতে মোট ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন আবেদন করেন। চলতি মাসে নিয়োগ চূড়ান্ত করে নিয়োগপত্র ছাড়া হয়।

এই নিয়োগ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চার কমিশনারের মতামত বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ইসি সচিবালয়ের সচিব নথি উপস্থাপন করার পর সিইসি নূরুল হুদা তা অনুমোদন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য চার কমিশনারকে কিছুই জানানো হয়নি। এতে তাঁরা অসন্তুষ্ট হন। নাম প্রকাশ না করে একজন কমিশনার বলেন, নিয়োগের পেছনে চার কোটি আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকার কোনো হিসাব নেই।

ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, চার কমিশনারের চিঠির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। নিয়োগের বিষয়ে সচিব বলেন, ৩৩৯ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে, নিয়োগপত্রও ছাড়া হয়েছে। আইনকানুন অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটাই ইসি সচিবালয়ে প্রথম নিয়োগ নয়, এর আগেও যেভাবে নিয়োগ হয়েছে, এবারও সেভাবেই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছে। অর্থ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসির প্রতিনিধিরা মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছেন। এরপর সিইসি অনুমোদন দিয়েছেন।

১৪ নভেম্বর সিইসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় আলোচনার একপর্যায়ে একজন কমিশনার নিয়োগের বিষয়টি তাঁদের না জানানোর বিষয়ে জানতে চান। জবাবে জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর বলেন, এই নিয়োগ ও এ-সম্পর্কিত অর্থ ব্যয় কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। সিইসিও তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানান। সচিব আরও বলেন, আইন অনুযায়ী শুধু নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অন্যান্য বিষয়াদি সিইসির অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সচিবের এই বক্তব্যের বিষয়টি চার কমিশনারের চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এরপর গতকাল রোববার চার কমিশনার একসঙ্গে সিইসিকে চিঠি দেন। চার কমিশনার চিঠিতে বলেছেন, ইসি সচিবালয় ও কমিশনের সব বিষয় সংবিধানসহ বিদ্যমান আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে তাঁরা সিইসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা জানানোর অনুরোধ করেছেন।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ নিয়ে তাঁরা কিছু বলেননি। কমিশনের অনেক বিষয় তাঁরা জানতে পারেন না, অনেক বিষয়ে নথিও তাঁদের কাছে পাঠানো হয় না। সব বিষয় যেন তাঁদের অবহিত করা হয়—এ বিষয়টি তাঁরা তুলে ধরেছেন।

চার কমিশনার তাঁদের চিঠিতে ইসি-সংক্রান্ত আইন ও বিধি তুলে ধরে যুক্তি দিয়েছেন, ইসি সচিবালয় প্রকৃতপক্ষে পুরো কমিশনের কাছেই দায়বদ্ধ। সে হিসেবে সচিবালয়ের সবকিছু কমিশনকে অবহিত করতে হবে। তাঁরা বলেছেন, কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচিবালয় গঠিত। ইসি সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে সব দায়িত্ব পালন করবেন। সচিব সিইসির মাধ্যমে কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য অনুমোদিত বাজেট নির্ধারিত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদনের ব্যাপারে কমিশনই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদন আবশ্যক। মাঝেমধ্যে নির্বাচন প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হলেও অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে কমিশনকে জানানো হয় না, যা নির্বাচন কমিশন আইনের ১৬ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।