গ্যাসলাইনে ছিদ্রের কারণেই বিস্ফোরণ

সেপটিক ট্যাংক নয়, গ্যাসের লাইনে ছিদ্রের কারণেই চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সেই বিস্ফোরণ থেকেই দেয়ালধস হয়। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ঘটনার জন্য ভবনমালিককেই দায়ী করা হয়েছে।

১৭ নভেম্বর সকাল নয়টার দিকে পাথরঘাটা এলাকার ব্রিকফিল্ড রোডের ‘বড়ুয়া ভবনের’ নিচতলায় বিস্ফোরণের এ ঘটনা ঘটে। এতে ৭ জন নিহত এবং অন্তত ১২ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে অনেকে এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। ঘটনার দিনই তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গ্যাসের পাইপলাইন ও রাইজার থেকে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস থেকেই এ দুর্ঘটনা হতে পারে। তবে ঘটনার পর নিয়মিত রাইজার ও গ্যাসলাইন পরীক্ষা না করায় কেজিডিসিএলের দায়ের বিষয়টি সবখানে আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে কেজিডিসিএল–এর দায়ের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জেড এম শরীফ হোসেন নিজের দপ্তরে প্রতিবেদনটি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বড়ুয়া ভবনটির মালিকানা তিনবার বদল হয়েছে। বর্তমানের আগের মালিকের সময়ে ভবনটির নিচতলায় মূল স্থাপনার বাইরে আলাদা করে ২০ বাই ৫ ফিটের বারান্দার মতো একটি জায়গা বাড়ানো হয়েছে। সেটি আলোবাতাসহীন বদ্ধ অবস্থায় ছিল। বাড়তি এই স্থাপনার ভেতরে গ্যাসের রাইজারটি ছিল।

শরীফ হোসেন বলেন, রাইজার থেকে যাওয়া গ্যাসের লাইনে ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্র থেকেই গ্যাস ছড়িয়ে আবদ্ধ (বাড়তি স্থাপনা) জায়গাটিতে অবস্থান করে। পরে সেই গ্যাস ভেতরের কক্ষেও প্রবেশ করে। সকালে পূজা দেওয়ার জন্য ওই বাসার বাসিন্দা সন্ধ্যা রানী নাথ মোমবাতি জ্বালাতে দেশলাইয়ের কাঠি ধরাতেই বিস্ফোরণ ঘটে।

রাইজারটিও ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে জানান শরীফ হোসেন। তিনি জানান, সেটির সঙ্গে মোড়ানো ট্যাপটিও ছিল অনেক পুরোনো। রাইজারটির একাংশ ভাঙা অবস্থায় তাঁরা পেয়েছেন। তবে তিনি বলেন, রাইজারটি বদ্ধ জায়গা না থেকে খোলা স্থানে থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না, কারণ তখন গ্যাস নিঃসৃত হয়ে চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেত।

কেজিডিসিএল যে প্রতিবেদন দিয়েছে—সেটিকে মনগড়া বলবেন কি না এমন প্রশ্ন করা হলে শরীফ হোসেন তা এড়িয়ে যান। তবে তিনি বলেন, ঘটনার পেছনে তাঁরা সেপটিক ট্যাংকের ভূমিকা নির্ণয় করতে পারেননি। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ বিষয়টি তাঁদের স্পষ্ট করেই বলেছেন। আর সেপটিক ট্যাংকে বিস্ফোরণ হলে সেটির ভেতরে যা আছে তা বাইরে বেরিয়ে আসত। কিন্তু এ রকম কিছুই হয়নি।

এ সময় তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন, পাথরঘাটার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী। 

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ইতিমধ্যেই এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আর তদন্তে প্রতিবেদনেও মালিককে মূল দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে এই প্রতিবেদনকে মামলার তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কেজিডিসিএল–এর দায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি—তারা জানিয়েছে ভবন মালিক গ্যাস নিঃসরণের বিষয়ে তাঁদের কিছুই জানাননি।’ 

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলতে কেজিডিসিএল–এর তদন্ত কমিটির প্রধান, প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও সেবা) মো. সারোয়ার হোসেনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 

পাঁচ সুপারিশ
এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি পাঁচটি সুপারিশ করেছে। সেগুলো হলো—ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড ও বিধিমালা যথাযথভাবে মানা। এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমানভাবে আইনের প্রয়োগ করার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (সিডিএ) অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। সিডিএ অননুমোদিত নকশা–বহির্ভূত যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, কেজিডিসিএল–এর আওতাধীন গ্যাসলাইন ও রাইজারগুলো নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া এবং পরীক্ষার পর ‘গ্যাসের লাইনটি পরীক্ষিত’ শীর্ষক সনদ দেওয়া। গ্যাসলাইন থেকে নিঃসরণ চিহ্নিতকরণ এবং সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া এবং গ্যাস সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের অভিযোগ জানাতে হটলাইন চালু করা।