সাক্ষীদের বয়ানে ভয়াবহ সেই রাত

২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। ফাইল ছবি
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। ফাইল ছবি

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলার রায় আজ বুধবার ঘোষণা করতে যাচ্ছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ভয়াবহ ওই হামলা হয়। জঙ্গিরা হত্যা করেছিলেন ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত এক বছরে রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় ১১৩ জন সাক্ষী হাজির করে।

সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম সাক্ষী ছিলেন পুলিশের উপপরিদর্শক রিপন কুমার দাস। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময় তিনি গুলশানে টহলে ছিলেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই বুঝতে পারেন তিনি একটা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পড়েছেন।

রিপন কুমার দাস এখন গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় কর্মরত। তিনি গত বছরের ৩ ডিসেম্বর আদালতে সাক্ষ্যে বলেন, ‘আমি রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ফোর্সসহ হোলি আর্টিজান এলাকায় যাই। গিয়ে দেখি আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চলছে। আমরা পাল্টা গুলি ছুড়ি।’ তিনি বলেন, এ সময় জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণে ৩০-৩৫ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন পরে মারা যান।

অভিযোগপত্রে সে রাতের অতিথি ও রেস্তোরাঁর আবহের একটা বিবরণ আছে। তাতে বলা হয়, প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত ছিল শুক্রবারের (১ জুলাই, ২০১৬) সন্ধ্যা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত রেজা করিম (হাসনাত করিম) মেয়ের জন্মদিন পালন করতে এসেছিলেন স্ত্রী শারমিনা পারভীন ও দুই সন্তানকে নিয়ে। তাঁরা বসেছিলেন হলরুমের পেছনের অংশে। তাহমিদ হাসিব খান, ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া এসেছিলেন রাত ৮টা ১০ মিনিটে। লনের লেকপাড় ঘেঁষা টালি ঘরটিতে বসেছিলেন তাঁরা। ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ রাত সাড়ে ৮টায় পাস্তা অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বন্ধু তন্ময়ের জন্য। ফারাজ আয়াজ হোসেন, তারিশি জৈন ও অবিন্তা কবির বসেছিলেন হলরুমে। নয়জন ইতালীয় রেস্তোরাঁয় এসেছিলেন বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ। তাঁরা বসেছিলেন নিচতলার একেবারে সামনের টেবিলে। তাঁরা সবাই বাংলাদেশে পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ইতালীয়দের পরই রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলেন জাপানি নাগরিকেরা। তাঁদের বড় অংশই বনানীর জাইকা অফিসের কর্মকর্তা। ঢাকার ইশরাত আখন্দ বসেছিলেন তাঁর শ্রীলঙ্কান বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে।

আর সব দিনের মতোই সবকিছু ছিল স্বাভাবিক। হাসি-আনন্দে মুখর হোলি বেকারির সন্ধ্যাবেলা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল রাত পৌনে নয়টার দিকে।

নিরাপত্তারক্ষী নূরে আলম আদালতে সাক্ষ্যে বলেছেন, ১ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরদিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত ফটকের দায়িত্বে তিনি ছিলেন। রাত পৌনে নয়টার দিকে পাঁচ তরুণকে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে দেখে তিনি তাঁদের পরিচয় জানতে চান। জবাব না দিয়েই তাঁরা রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে যান। থামতে বললে তরুণদের একজন ‘ওই ব্যাটা, সর’ বলে নূরে আলমের নাকের নিচে ঘুষি দিয়ে ভেতরে ঢুকে যান।

হোলি আর্টিজানের অতিথিরা তখনো ওই যুবকদের পরিচয় জানেন না। ভেবেছিলেন, ওঁরাও তাঁদের মতোই অতিথি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাঁরা আল্লাহু আকবার বলে গুলি ছুড়তে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন, ‘তোমাদের ভয় নাই, আমরা মুসলমানদের মারব না, টেবিলের নিচে মাথা নিচু করে থাকো।’

হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীনের সাক্ষ্যে সে সময়কার পরিবেশ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, হামলাকারীরা বলেন যে মুসলমানদের কোনো সমস্যা নেই। এরপরই তাঁরা ৮-১০ জন বিদেশি নাগরিককে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। কিছুক্ষণ পর দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে এবং এক ব্যক্তিকে হামলাকারীরা তাঁদের (শারমিনা পারভীন) টেবিলের কাছে বসান। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটারের পাশে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় বিদেশি এক নাগরিককে। শারমিনা পারভীন আদালতে বলেন, ‘ডেডবডি ছড়ানো ছিল আমাদের চারপাশে। সেগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর শব্দ পাই।’

এ সময় রেস্তোরাঁর কর্মীদের কেউ কেউ পালিয়ে পাশের লেকভিউ ক্লিনিকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সমীর বাড়ৈসহ কর্মীদের কয়েকজন লুকিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। সমীর আদালতে বলেন, তাঁরা রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ ওয়াশরুমে ধাক্কাধাক্কি শুনতে পান। বাইরে থেকে কেউ বলে দরজা না খুললে বোমা মেরে উড়িয়ে দেব। তাঁরা দরজা খুলে দেখেন আগ্নেয়াস্ত্র ও চাপাতি হাতে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। সমীরসহ সেখানে থাকা সবাই বাংলাদেশি নিশ্চিত হয়ে তাঁদের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে দেন ওই দুজন (হামলাকারী জঙ্গি)। এরপর পর্যায়ক্রমে টয়লেট, ছাদ, কিচেন, চিলাররুমে লুকিয়ে থাকা বিদেশিদের খুঁজে বের করে গুলি ও ধারালো ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন জঙ্গিরা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, সে রাতে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির মধ্যে মীর সামেহ মোবাশ্বের ও নিবরাস ইসলাম হোলি আর্টিজানের এক পাশ থেকে এবং অন্য পাশ থেকে রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল প্রবেশ করেন। তাঁরা প্রথমেই হত্যা করেন ইতালীয়দের।

সেখান থেকে বেঁচে ফেরা ফাইরুজ মালিহা আদালতে বলেন, জঙ্গিরা তাঁকে বলেন পুলিশকে ফোন করে জানাতে, যেন আক্রমণ না করে। হুমকি দেন আক্রমণ করলে কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না।

এর মধ্যেই জঙ্গিরা হোলি আর্টিজান বেকারির কর্মচারীদের কাছ থেকে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জেনে নেন। একপর্যায়ে হামলাকারীরা অতিথিদের ফোন ব্যবহার করে হোলি আর্টিজানের নৃশংসতার ছবি পাঠাতে শুরু করেন তামিম আহমেদ চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে। মানুষ দ্রুতই জেনে যায় হোলি আর্টিজানের দখল নিয়েছেন জঙ্গিরা। রাত ১১টার মধ্যেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিসহ মোট ছয়জন নিহত হন। এরপর ঘটনাস্থল বুঝিয়ে দেওয়া হয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। আদালতে সিআইডির পরিদর্শক প্রশান্ত কুমার দেবনাথ বলেন, তিনি নিচতলার কক্ষে গিয়ে দেখতে পান ২০ জনের মরদেহ। পাঁচ জঙ্গির মরদেহের কাছেই পড়ে ছিল হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর এক বাবুর্চির মরদেহ। প্রশান্ত কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, রেস্তোরাঁর ওই কক্ষের আয়তন ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট। কক্ষ থেকে রক্ত চুইয়ে আসছিল লনের দিকে। জীবনে বহু মরদেহ দেখলেও হোলি আর্টিজানের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরদেহগুলোর কথা তিনি ভুলতে পারেন না।