জঙ্গিরা অনুকম্পা পেতে পারে না

রায় শেষে হোলি আর্টিজান হামলা মামলার আসামি রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর হোসেনকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গতকাল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে।  ছবি: হাসান রাজা
রায় শেষে হোলি আর্টিজান হামলা মামলার আসামি রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর হোসেনকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গতকাল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে। ছবি: হাসান রাজা
>সাত আসামির মৃত্যুদণ্ড, একজন খালাস। খালাস হওয়া আসামির বিষয়ে আপিল করবে পুলিশ।

হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জঙ্গিরা শিশুদের সামনে হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করেছে। এই আসামিরা কোনো ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না।

গতকাল বুধবার আলোচিত এই মামলার রায়ে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। রায়ে অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও হামলাকারীদের সহায়তা করা। তবে আদালত বলেছেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনা করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী, যিনি ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের এক জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‍্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ। আদালত বলেছেন, অভিযুক্তরা সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯–এর (২)–এর (অ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডে এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো। মিজানুর রহমান নামে অভিযুক্ত আরেকজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

বিচারক মজিবুর রহমান বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা সারা বিশ্বে প্রমাণ করেছি যে এ রকম ঘটনার দ্রুত বিচার হয়।’

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আইনজীবী হিসেবে আমি আদালতের রায়কে প্রত্যাখ্যান করি না। আবার যে দণ্ড প্রদান করা হয়েছে, তাতে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।’

তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে অভিজাত রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী পাঁচ জঙ্গি হামলা চালায়। তারা বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের, তিনজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয় নাগরিক। এ ছাড়া দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন জঙ্গিদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড ও গুলিতে।

এই হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নামে দায় স্বীকার করা হলেও পুলিশ বলেছে, এই হামলায় জড়িতরা দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবির সদস্য। তদন্তে এই হামলায় মোট ২১ জন জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। এর মধ্যে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে এবং আটজন পরবর্তী সময়ে র‍্যাব-পুলিশের অভিযানে নিহত হয়। বাকি আটজনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

গতকাল বহুল আলোচিত এই মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। দুই দফা তল্লাশির পর আইনজীবী, সাংবাদিক ও আদালতে আসা ব্যক্তিদের আদালতে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়। সকাল ১০টা ২৩ মিনিটে একটি প্রিজন ভ্যানে করে কেরানীগঞ্জের কারাগার থেকে আট আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়।

বিচারক রায় ঘোষণার আগে এজলাসকক্ষ আরও একবার তল্লাশি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুপুর ১২টার পরপর বিচারক মো. মজিবুর রহমান এজলাসে আসেন। তিনি রায় ঘোষণার আগে বিচারিক প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ​দেন। তাতে তিনি বিশেষভাবে তানভীর কাদেরীর ছেলের (অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে নাম দেওয়া হলো না) সাক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন। ঢাকার এক জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে তানভীর কাদেরী নিহত হন। তাঁর ছেলে আদালতে দুই আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী ও আসলাম হোসেন ওরফে র‍্যাশকে শনাক্ত করে। সে জানায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাদের ভাড়া বাসা থেকে পাঁচ জঙ্গি হোলি আর্টিজানে হামলার জন্য রওনা হয়েছিল। ওই বাসায় সে রাজীব গান্ধী ও র‍্যাশকে দেখেছে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ
রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বাংলাদেশে তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে যান, তখন আকস্মিকভাবে তাঁদের ওপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হোলি আর্টিজান বেকারি। কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়। সে জন্য সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আসামিরা কোনো ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯–এর ৬(২)(অ) ধারার প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং ভাগ্যহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন।

 বিচারক মজিবুর রহমান বলেন, হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়কারী ছিলেন তামিম চৌধুরী। আসামি আসলাম হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, ‘আমি তখন তামিম ভাইয়ের কাছে গুলশান বা কোনো কূটনৈতিক এলাকায় আক্রমণের উদ্দেশ্য জানতে চাই। তামিম ভাই বলে যে, আমাদের সংগঠন নব্য জেএমবি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই গুলশান কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করা প্রয়োজন।’ এটি প্রতিষ্ঠিত যে তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে হোলি আর্টিজান হামলা সংঘটিত হয়।

আসামিদের ঔদ্ধত্য
রায় ঘোষণা পর্যন্ত আসামিদের কোনো ভাবান্তর ছিল না। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর সমস্বরে তাঁরা স্লোগান দেন এবং চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে আসামিদের অনেকটা জোর করে এজলাস থেকে হাজতখানার দিকে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রিজন ভ্যানে ওঠার পর আসামিরা চিৎ​কার করে তাঁদের কর্মকাণ্ডের পক্ষে হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেন। এ সময় সবচেয়ে সরব ছিলেন আসলাম হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেন। তাঁরা আইএসের পক্ষেও বক্তৃতা করেন।

খালাস আসা​মির বিষয়ে আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ
ট্রাইব্যুনালের বিচারে সন্তুষ্ট হলেও আসামি মিজানুর রহমানের খালাস পাওয়া নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছে পুলিশ। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ওই আসামির বিষয়ে তাঁরা আপিল করবেন।

 এই রায় সন্ত্রাসীদের জন্য একটা বার্তা
রায় ঘোষণার পর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম। প্রত্যাশিত রায় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা এই রায়ের মাধ্যমে একটি বার্তা পাবে। জঙ্গিগোষ্ঠীটি বড় পরিসরে হামলার ক্ষমতা হারিয়েছে। তবে তারপরও সতর্ক থাকা জরুরি।