সাংসদ লিটন হত্যায় সাবেক সাংসদসহ ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায়ে একই আসনের আরেক সাবেক সাংসদ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল কাদের খানসহ সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক এই রায় দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল কাদের খান, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. শামসুজ্জোহা, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, গৃহকর্মী মেহেদী হাসান, শাহীন মিয়া ও আনোয়ারুল ইসলাম রানা এবং চন্দন কুমার সরকার। এর মধ্যে কাদের খানসহ ছয়জন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। অপরজন চন্দন কুমার সরকার ভারতে পলাতক অবস্থায় সেখানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।

এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী, মনজুরুল ইসলাম লিটনের স্বজন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীসহ রাজনীতিবিদেরা। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।

পুলিশ ও মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিহত হন। এই ঘটনায় লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলী বুলবুল সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি দেখানো হয়। ঘটনার পর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়। সে সময় জামায়াত-শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়।

ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া একটি ম্যাগাজিনের সূত্র ধরে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার বাসা থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবদুল কাদের খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাদের খান গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ। পুলিশ তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল কাদের খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। অপর সাতজন আসামি হলেন কাদের খানের একান্ত সহকারী (পিএস) মো. শামসুজ্জোহা, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, বাড়ির কাজের লোক মেহেদি হাসান, শাহীন মিয়া, আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে রানা, সুবল কসাই এবং চন্দন কুমার সরকার। এর মধ্যে সুবল কসাই কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। চন্দন কুমার সরকার ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর থেকে কাদের খানসহ ছয়জন গাইবান্ধা জেলা কারাগারে রয়েছেন।

এ ছাড়া লিটন হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া অস্ত্র আইন মামলায় গত ১১ এপ্রিল আবদুল কাদের খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। লিটন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত তিনটি অস্ত্রের মধ্যে একটি অস্ত্র কাদের খান নিজে থানায় জমা দেন। একটি অস্ত্র ৬টি গুলিসহ তাঁর বাড়ির উঠান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে অপর অস্ত্রটির সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।

২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল এই মামলার প্রথম দফায় আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বাদী, নিহত সাংসদের স্ত্রী, তদন্ত কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ৫৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। গত ৩১ অক্টোবর মামলার সাক্ষী গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পরে পর্যায়ক্রমে কারাগারে থাকা আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি হয়।

গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়। রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণা উপলক্ষে প্রধান আসামি আবদুল কাদের খানসহ অন্যদের কড়া নিরাপত্তায় আদালতে আনা হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকা, গাইবান্ধা, ২৮ নভেম্বর। ছবি: শাহাবুল শাহীন
গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়। রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণা উপলক্ষে প্রধান আসামি আবদুল কাদের খানসহ অন্যদের কড়া নিরাপত্তায় আদালতে আনা হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকা, গাইবান্ধা, ২৮ নভেম্বর। ছবি: শাহাবুল শাহীন

১৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিকের আদালতে সাক্ষী ও আসামিদের উপস্থিতিতে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। চলে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। তবে প্রথম দিনে যুক্তিতর্ক শেষ না হওয়ায় আদালত মুলতবি ঘোষণা করে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে আবারও যুক্তিতর্ক শুনানির দিন ধার্য করেন বিচারক।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্কের প্রথমে আদালতে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এ সময় আসামিদের পক্ষে আইনজীবীরা কাদের খানকে নির্দোষ দাবি করে আদালতে যুক্তি খণ্ডান। মামলার এজাহার, আসামি-সাক্ষীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, অস্ত্র উদ্ধারসহ নানা দিক আলোকপাত করে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। এ সময় আদালতে মামলার সাক্ষী ও নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন।

সরকারি কৌসুলি (পিপি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রায় সঠিক হয়েছে। আমরা খুশি।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও আদালত সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ করলে আসামিরা নির্দোষ প্রমাণিত হবে। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’

কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা
মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই রায়কে ঘিয়ে আদালত চত্বরে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় ছিলেন সকাল থেকেই। আদালত চত্বরে প্রবেশের মূল ফটকে বসানো হয় নিরাপত্তাচৌকি। বেলা ১১টা ১৮ মিনিটের দিকে গাইবান্ধা জেলা কারাগার থেকে আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় আদালত চত্বরে। এরপর আদালতের হাজতখানায় রেখে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নেওয়া হলে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করেন বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক।