অনুমতি ছাড়া বিএনপির বিক্ষোভের জের

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির ও ইশতিয়াক আজিজ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির ও ইশতিয়াক আজিজ।

বিএনপিতে হঠাৎ​ করে গ্রেপ্তারের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনুমতি ছাড়া রাজধানীতে বিক্ষোভের পর গ্রেপ্তারের ঘটনায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে এ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতা হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও খায়রুল কবির খোকন বিকেলে নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ চার নেতাও গতকালই উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন।

হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও খায়রুল কবিরকে গতকাল হাইকোর্টের ফটক থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) গ্রেপ্তার করে। এর আগে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক হন মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ। তিনি মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিএনপির নেতা-কর্মীদের হঠাৎ​ করে রাস্তায় বিক্ষোভ করা এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিব্রত করেছে। তাদের ধারণাতেই ছিল না, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া বি​এনপির নেতা-কর্মীরা এভাবে রাস্তায় নেমে কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখবেন। বিষয়টি পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কারণ এর আগেই বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা অনুমতি না নিয়ে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, হঠাৎ​ রাস্তায় বিক্ষোভ করে বিএনপির নেতারা প্রশাসনকে একটা এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, তাঁরা এখন থেকে কর্মসূচি পালন করতে কারও অনুমতির অপেক্ষা করবেন না। এ পরিস্থিতিতে পুলিশও বিএনপিকে পাল্টা বার্তা দিতে পাঁচ শতাধিক নেতাকে জড়িয়ে মামলা দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তারে তৎ​পর হয়েছে।

বি​এনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের সামনে বিক্ষোভ করে বিএনপির সমর্থক ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম’। এ সময় বিএনপির কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এরপর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সে রাতেই পুলিশ বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতকে গ্রেপ্তার করে। এরপর বিএনপির সহসভাপতি হাফিজউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির ও ডাকসুর নির্বাচনে ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এ পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার এড়াতে গতকাল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল আগাম জামিনের আবেদন করেন।

হাইকোর্ট চার নেতাকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। একই সঙ্গে তাঁদের এই সময়ের মধ্যে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে শুনানির কার্যক্রমে দেখতে গিয়ে দুপুরে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার এড়াতে জামিন না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই বসে ছিলেন। কারণ আদালত থেকে বের হওয়ার পর হাফিজউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খায়রুল কবির গ্রেপ্তার হন হাইকোর্টে ঢোকার পথে। হাফিজউদ্দিন নিজের একটি মামলায় হাজিরা দিতে হাইকোর্ট থেকে বের হয়ে নিম্ন আদালতে যাচ্ছিলেন।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন ভূমিকায় তাঁরা কিছুটা অপ্রস্তুত। তাঁরা ধারণা করতে পারেননি, পুলিশ একটি বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের মহাসচিবসহ এত জ্যেষ্ঠ নেতাকে জড়িয়ে মামলা দেবে, যা ‘গায়েবি’ মামলার মতোই ভয়ংকর বলে মনে করেন নেতারা। কারণ, এ ঘটনায় পুলিশ শাহবাগ থানায় ২৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০০ জনকে আসামি মামলা করে। এতে বিএনপির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যসহ জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদেরও আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে দেখা যায়, তিন-চারজন ছাড়া আসামির তালিকায় থাকা মির্জা ফখরুল ইসলামসহ অধিকাংশ নেতাই সে দিনের বিক্ষোভে ছিলেন না। পুলিশ এজাহারে মির্জা ফখরুল ও গয়েশ্বর রায়ের নাম এই বলে যুক্ত করেছে যে, বিক্ষোভকারীরা ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’, ‘অবৈধ সরকারের পতন চাই’—এ ধরনের উসকানিমূলক স্লোগান দেয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালে তাঁরা বলেন, বিএনপির মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন, নেতা-কর্মীরা যখন যেখানে খুশি সমাবেশ করবেন এবং তার জন্য পুলিশ বা কারও অনুমতি নেবে না। এজাহারে গত ২৪ নভেম্বর নয়াপল্টনের সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলামের দেওয়া বক্তব্য ধরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘অনুমতি নেব না, যখন প্রয়োজন সমাবেশ করব’ শিরোনামটি উদ্ধৃত করা হয়।

এ বিষয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক বক্তব্যের ওপর কখনো কি মামলা হয়? তাহলে ওবায়দুল কাদের কী করে বলেন, আমাদের মুরোদ নেই, আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই। এটা কি উসকানি নয়? পুলিশ এই উসকানিমূলক বক্তব্যের জন্য কী করেছে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, সভা-সমাবেশ, মিছিল করা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের কোথায় আছে পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল করা যাবে না।

সারা দেশে মামলার তথ্য সংগ্রহের জন্য গঠিত বিএনপির মনিটরিং সেল সূত্র জানায়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বি​এনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সারা দেশের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১ হাজার ৯৮৬টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে আসামির সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৫ জন। এর মধ্যে বর্তমানে জেলে আছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৮০৪ জন।

হঠাৎ​ গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, জুলুমবাজ সরকার দেশের বিরোধী শক্তিকে জর্জরিত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সরকারের দুর্বিনীত হাতের হিংস্রতা এই মুহূর্তে চরম আকার ধারণ করেছে। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ।