চেইনম্যানের কোটিপতি স্ত্রী

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রাম নগরের একটি শপিং মলে তিনটি দোকান। ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকা। অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট। এসব সম্পত্তির মালিক আনোয়ারা বেগম নামে এক নারী। তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম ভূমি কার্যালয়ের একজন শিকলবাহক (চেইনম্যান)।

নজরুলের ব্যাংক হিসাবেও আছে কোটি টাকা। কিন্তু তাঁর নামে কোনো আয়কর ফাইল নেই। স্ত্রীর সর্বশেষ আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, ১৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বৈধ আয় করেছেন। অথচ জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে তাঁরা অর্জন করেছেন ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৮ টাকার স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

নজরুল ইসলাম এক সময় চট্টগ্রাম জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের শিকলবাহক (চেইনম্যান) ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকেসহ তিনজনকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এরপর তাঁর কর্মস্থল হয় ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদে। ৭ নভেম্বর নজরুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী তছলিম উদ্দিন ধরা পড়েন দুদকের হাতে। ওই সময় নজরুলের কাছে পাওয়া যায় প্রায় ৯১ লাখ টাকার চেক ও নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এ ঘটনায় দুদক মামলা করেছে।

দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালে ১ হাজার ৮০০ টাকা বেতনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন নজরুল। এখন তাঁর বেতন ২৫ হাজার টাকা। নগরের ও আর নিজাম রোডে স্ত্রী আনোয়ারার নামে দুই বছর আগে কেনেন অর্ধ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর গুমানমর্দনে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে নির্মাণ করেন দুই তলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি।

>

স্বামী ভূমি কার্যালয়ের শিকলবাহক
ঘুষ–দুর্নীতির টাকায় স্ত্রী দোকান, ফ্ল্যাট ও গাড়ির মালিক

ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায় নজরুলের নামে দুটি হিসাব রয়েছে। ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুটি হিসাবে ৪ কোটি ৮৬ লাখ ৬৯ হাজা টাকা জমা হয়। উত্তোলন করেন ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বর্তমানে তার দুটি হিসাবে আছে ২১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ওই ব্যাংকের শাখায় তার স্ত্রী আনোয়ারার একটি হিসাবে ২০১৫ সালের ২২ মার্চ থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত জমা হয় ২ কোটি ৪৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। আর উত্তোলন করেন ২ কোটি ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০০১ সালে কেনা চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে আনোয়ারার নামে থাকা ‘আনুকা’ ও ‘ফেমিলি ফেয়ার’ নামের দুটি দোকানের হিসাবে ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর উত্তোলন করা হয় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বর্তমানে দুটি হিসাবে জমা আছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া চিটাগাং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় আরেকটি দোকান রয়েছে, যার মূল্য ৮৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে একটি প্রাইভেট কারও রয়েছে।

দুদক সূত্রের ভাষ্য, নজরুলের বড় ছেলে সম্প্রতি লন্ডন থেকে এমবিএ করেছেন। ছোট ছেলে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন। দুই ছেলের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও পারিবারিক ব্যয় বাদ দিলে তাঁর কোনো সঞ্চয় থাকার কথা নয়। স্ত্রী আনোয়ারা তাঁর নিজে নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বৈধ আয় করেছেন। অথচ আনোয়ারা গাড়ি, ফ্ল্যাট ও তিনটি দোকানের মালিক।

ভুক্তভোগীরা জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধিগ্রহণ করা ভূমির ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন নজরুল। তিনি ফটিকছড়িতে কর্মরত থাকলেও চট্টগ্রাম এলএ শাখা ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়।

নজরুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে দোকান, ফ্ল্যাট কিনেছেন। তাঁদের কাছে যাবতীয় কাগজপত্র রয়েছে। তিনি নিজে কিছু করেন না। স্বামীর কিনে দেওয়া দোকানের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। দোকানের আয় দিয়ে বেশকিছু সম্পত্তিও কিনেছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সামান্য বেতনের কর্মচারী হয়েও নজরুল ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। তাদের নামে আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ওই টাকার মালিক হয়েছেন স্বামী–স্ত্রী।