মাল্টার পর বরেন্দ্র অঞ্চলে এবার কমলার হাসি

একসময় কৃষকদের মধ্যে ধারণা ছিল, বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কেবল ধান চাষের জন্যই উপযোগী। কিন্তু ধীরে ধীরে কৃষির নানা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে সে ধারণাও পাল্টেছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন জাতের ফসল চাষে সফলও হয়েছেন কেউ কেউ। মাল্টা চাষে সফলতার পর এবার কমলা চাষেও ঝুঁকছেন কৃষকেরা।

২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বারি মাল্টা-১ চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মতিউর রহমান। তাঁর বাগানের মাল্টার চারা উৎপাদন করেও ছড়িয়ে দেন বরেন্দ্র এলাকার অন্য চাষিদের মধ্যে। মাল্টায় সফলতার পর এবার কমলা চাষ শুরু করেছেন তিনি।
ফলের পাশাপাশি চারা কিনতেও হাজির হচ্ছেন অন্য চাষিরা।

মতিউর রহমানের বাড়ি নাচোলের খলসি গ্রামে। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি করেন ফলের চাষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-আমনূরা সড়কের পাশে জামতাড়া এলাকায় প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে মতিউর রহমান গড়ে তুলেছেন মনামিনা কৃষি খামার। এখানে বিভিন্ন জাতের কমলার গাছ আছে ৫০০টির মতো। তিন বছর বয়সী গাছগুলো ফল দিতে শুরু করেছে। গাছপ্রতি কমলার ফলন হচ্ছে প্রায় ৬০ কেজি। বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে। আকার অনুযায়ী ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে চারা।

সম্প্রতি বাগান ঘুরে দেখতে গেলে মতিউর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার চারা বিক্রি করেছেন। বাগান ঘুরে দেখান পাকিস্তানি, যুক্তরাষ্ট্রের মেন্ডালিন, চায়না, ভারতীয় নাগপুরিসহ প্রায় ২০ জাতের কমলার গাছ। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা কমলা দেখিয়ে মতিউর রহমান জানাচ্ছিলেন চাষের পদ্ধতিও।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট একটি বড় সমস্যা। এ সংকট মোকাবিলায় ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করেন মতিউর রহমান। এ পদ্ধতিতে সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে গভীর নলকূপের মাধ্যমে উঁচু ট্যাংকে পানি তোলা হয়। পরে ট্যাংক থেকে পানি যায় পাইপে। মূল পাইপ থেকে সরু পাইপের মাধ্যমে পানি দেওয়া হয় প্রতিটি গাছের গোড়ায়। মতিউর রহমান বলছিলেন, এই পদ্ধতিতে পানির অপচয় হয় না।

নিজের কমলাবাগানে ফলের পরিচর্যা করছেন চাষি মতিউর রহমান।  ছবি: প্রথম আলো
নিজের কমলাবাগানে ফলের পরিচর্যা করছেন চাষি মতিউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

মতিউর রহমানের বাগান পরিদর্শনে এসেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক মোজদার হোসেন। তিনি বলছিলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর যেভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে, তাতে এই পদ্ধতিতে ধানের বিকল্প হিসেবে ফল চাষ কৃষকদের নতুন আশা দিতে পারে।

মোজদার হোসেন আরও বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা কমলার চেয়ে দেশে চাষ করা কমলার স্বাদ কোনো অংশে কম নয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও দীর্ঘ সংরক্ষণের জন্য বিদেশি কমলার পুষ্টিমান ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বাগানের কমলায় সেই আশঙ্কা নেই।

ফলের বাগানের আয় থেকে শহরের শাহীবাগ এলাকায় আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মতিউর রহমান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচারের সামনে সড়কের পাশে স্থাপন করেছেন চারা বিক্রয় কেন্দ্র। সেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রকার ফল, ফুল ও ভেষজ গাছের চারা বিক্রি করা হয়। নিজের ও বাগানের কর্মচারীদের চালের সংস্থানের জন্য এ বছর চার বিঘা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে আমন ধানের চাষও করেছেন মতিউর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হুদা মতিউর রহমান সম্পর্কে বলেন, ‘এরই মধ্যে তিনি আধুনিক ফলচাষি হিসেবে এলাকায় পরিচিত পেয়েছেন। ফল চাষে তাঁর গবেষণামূলক মনোভাবও আছে। এ ছাড়া, পানি সাশ্রয়ের জন্য তাঁর ব্যবহৃত সেচ পদ্ধতি বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্য চাষিদেরও অনুসরণ করা উচিত।’