পাহাড়ি নারীর কোমরতাঁত

জরি ও সুতা দিয়ে পরনের কাপড় রিনাই তৈরি করছেন ত্রিপুরা নারীরা। গত ২৮ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাঙ্গালকাটিমুখ ত্রিপুরাপাড়ায়।  ছবি: নীরব চৌধুরী
জরি ও সুতা দিয়ে পরনের কাপড় রিনাই তৈরি করছেন ত্রিপুরা নারীরা। গত ২৮ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাঙ্গালকাটিমুখ ত্রিপুরাপাড়ায়। ছবি: নীরব চৌধুরী

কোমরতাঁতের মধ্যে কেউ বাণিজ্য খুঁজতে যাবেন না। বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নয়, যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের নারীরা কোমরতাঁতে তৈরি করে আসছেন নিজেদের পরিধেয় পোশাক। চাকমা নারীরা তৈরি করেন পিনোন-হাদি, ত্রিপুরা নারীরা রিনাই-রিচা। তাঁদের মতোই মারমা নারীরাও তৈরি করেন শাল, বুরগি (কম্বল), মাফলার, পাপোশ, ব্যাগসহ নানা ধরনের পোশাক।

পাহাড়ে জুম চাষ শেষ হওয়ার পর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পাহাড়ের বেশির ভাগ নারীর কোনো কাজ থাকে না। তাই বলে কি অলস সময় কাটাতে হবে? বাড়তি আয়ের আশায় তাই কোমরতাঁতের পোশাক তৈরি শুরু করেন তাঁরা। গ্রামে ও স্থানীয় বাজারে এর কিছু কিছু বিক্রিও হয়। যাঁরা তৈরি করতে পারেন না, তাঁরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পিনোন-হাদি তৈরির অর্ডার দেন।

মাটিরাঙ্গা বড়নাল বড় ত্রিপুরাপাড়ার যুবনিকা ত্রিপুরা ১৭ বছর ধরে কোমরতাঁতে কাজ করেন। যখন কথা হয়, তখনো তাঁত নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘জুম চাষ করে সাতজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। তাই গৃহস্থালির কাজ করেও তাঁতে কাজ করি। জুম চাষের ওপর নির্ভর না করে সারা বছর রিনাই-রিচা তৈরি করি।’

‘মাসে কটা তৈরি করেন?’

‘প্রতি মাসে দু-তিন জোড়া রিনাই-রিচা বানাই। প্রতি জোড়া বিক্রি হয় ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। মাস শেষে আয় হয় ৪-৫ হাজার টাকা। এতে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে।’

পানছড়ি পুজগাং এলাকার মানসী চাকমা বলেন, ‘ধান কাটা ও ধান ওঠানো শেষ হয়েছে দুই সপ্তাহ আগে। ঘরের কাজ ছাড়া হাতে কোনো কাজ নেই। তাই ১ হাজার ৫০০ টাকার সুতা কিনে তিনটি বুরগি (কম্বল) বুনছি। এই তিনটি বুরগি বিক্রি করে পাব ৪ হাজার ৫০০ টাকা।’

খাগড়াছড়ির গাছবান এলাকার প্রিয়লতা চাকমা বললেন, ‘জুমে এখন কোনো কাজ নেই, আমাদের মতো খেটে খাওয়া লোকদের বাজার থেকে কিনে পিনোন-হাদি পরতে হলে না খেয়ে থাকতে হবে। এখন যেহেতু কোনো কাজ নেই, তাই নিজের জন্য এক জোড়া পিনোন-হাদি তৈরি করছি।’

পানছড়ি কলেজের শিক্ষার্থী তিথি চাকমা প্রতিবছর শীতের দুই মাস আগে থেকে মাফলার বুনে জমা করে রাখেন। একটি মাফলার তৈরি করতে সময় লাগে দুই দিন। গত শুক্রবার পাইকারি বিক্রি করেছেন ৫০টি। প্রতি মাফলারে খরচ হয় ৫০ টাকা আর বিক্রি করেন ১২০ টাকায়।

দাম বেড়েছে উপকরণের, বাড়েনি কাপড়ের দাম। তবু কোমরতাঁতের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন পাহাড়ের নারীরা। পাহাড়ের নারীরা ছাড়াও পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে পাহাড়ি নারীদের তৈরি এই পোশাকগুলো।