স্পিচথেরাপি-বঞ্চিত হাজারো প্রতিবন্ধী

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের একটি থেরাপি কক্ষ। গতকাল সকালে।  ছবি: প্রথম আলো
প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের একটি থেরাপি কক্ষ। গতকাল সকালে। ছবি: প্রথম আলো

মুন্নির বয়স প্রায় তিন বছর। জন্মের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে মুন্নি স্বাভাবিকতা হারায়। নড়াচড়া করা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজ—কিছুই সে করতে পারছে না। এমনকি টুকটাক কথা শিখে উঠতে পারেনি সে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ, কথা বলা ও ভাব বিনিময় করার জন্য শিশুটির স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজথেরাপি প্রয়োজন।

চিকিৎসা পেতে মা মাজেদা বেগম গতকাল সোমবার ভৈরব প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রে আসেন। কিন্তু কেন্দ্রটিতে কোনো থেরাপিস্ট না থাকায় চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে। মাজেদা বলেন, ‘সন্তানের থেরাপি পাওয়ার জন্য কিছুদিন ধরে কেন্দ্রটিতে আসা–যাওয়া করছি। বুদ্ধি–পরামর্শ আর অন্য বিভাগের সহকারীদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু চিকিৎসা ছাড়া ভালো কিছু পাচ্ছি না। এসবে আমার সন্তানের কোনো পরিবর্তনও আসেনি।’ মাজেদা নরসিংদীর রায়পুরার রাধানগর ইউনিয়নের সাহেরচর গ্রামের মাসুদ রানার স্ত্রী।

ভৈরব প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, মুন্নি নড়াচড়া করতে পারে না, বয়স হিসেবে স্বাভাবিক কোনো কাজ পারে না। এমন প্রতিবন্ধীদের থেরাপির মাধ্যমে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে অকুপেশনাল থেরাপি দেওয়া হয়। স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজথেরাপি দেওয়া হয় কথা বলতে না পারার সমস্যা সমাধান করার জন্য। এই থেরাপি গ্রহণ করলে শিশুদের মধ্যে যোগাযোগক্ষমতা বাড়ে এবং একটি শিশু অন্য একটি শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ থাকলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভৈরব প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রে অকুপেশনাল, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগে কাউকে পদায়ন করা হয়নি। শত শত প্রতিবন্ধী এই দুই বিভাগের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেবাপ্রত্যাশীদের অনেকে নারী। তবে এই কেন্দ্রে বর্তমানে নারী থেরাপিস্ট নেই। থেরাপি হাতে–কলমে দিতে হওয়ায় পুরুষদের দ্বারা নারীদের অনেকে থেরাপি নিতে বিব্রত বোধ করেন। একজন নারী থেরাপিস্ট না থাকায় অনেক নারী যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী সেবাপ্রত্যাশী বলেন, ‘পুরুষের মাধ্যমে থেরাপি নিতে গিয়ে নিজের সমস্যার কথা ভালো বলতে পারি না। পুরুষ থেরাপিস্টরাও সংকোচ বোধ করেন। ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।’

চিকিৎসকেরা জানান, ভৈরবে এই কেন্দ্রের যাত্রা ২০১০ সালের ১৪ মার্চ। তখন সারা দেশে কেবল পাঁচটি কেন্দ্র চালু করা হয়। দেশে বর্তমানে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র রয়েছে। চালুর পর তেমন কোনো আধুনিকায়ন বা সেবা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সেখানে।

কেন্দ্রটির অবস্থান ভৈরব পৌর শহরের বঙ্গবন্ধু সরণিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের বাড়ির বিপরীতে। ছয় কক্ষের একটি ভাড়া বাড়িতে কেন্দ্রটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এই কেন্দ্র থেকে বর্তমানে ৬ হাজার ৬২০ জন নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী সেবা নিচ্ছে। সেবা গ্রহণকারীর মধ্যে ভৈরব ছাড়াও একই জেলার কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নরসিংদীর রায়পুরা, বেলাব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, সরাইল ও নবীনগরের প্রতিবন্ধী রয়েছে। কেন্দ্রের মূল পদগুলোর মধ্যে একজন করে প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা, কনসালট্যান্ট থেরাপিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফিজিও থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট পদে লোক থাকার কথা। এখানে অন্য পদগুলোতে লোক থাকলেও অকুপেশনাল, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ পদ দুটি শুরু থেকেই নেই।

গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। জানানো হয় অফিসের প্রয়োজনে তিনি বাইরে আছেন। তখনো প্রায় ১৫ জন মা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে চিকিৎসা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।

মুকছেদুল ইসলাম এই কেন্দ্রের একমাত্র ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট। দেড় বছর ধরে তিনি এই সেন্টারে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের অনেকের অকুপেশনাল, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজথেরাপি প্রয়োজন হয়। এই কথা সত্য পদায়ন না থাকায় আমাদের কেন্দ্রে এই বিভাগে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মুঠোফোনে কথা হয় কেন্দ্রটির প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এসব এই পদে কেন্দ্রীয়ভাবেই লোকবলের অভাব রয়েছে। আমাদের অফিসের দুজনকে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছি। তাঁদের দিয়ে কোনো রকম কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। তবে থেরাপিস্ট থাকলে সেবাপ্রত্যাশীরা প্রত্যাশিত সেবা পেত এবং উপকৃত হতো।’