ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে ট্রেনের গতি গড়ে ৩০ কিমি

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ এবং সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুটি ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচলের স্বাভাবিক গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, আন্তনগর ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছাতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। রেলসংশ্লিষ্ট লোকজনের ভাষ্য, যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ও দুর্ঘটনা এড়াতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে যাত্রীরা মনে করেন, রেলের আধুনিকায়ন না করে উল্টো মান্ধাতা আমলে ফিরে যাচ্ছে রেলব্যবস্থা।

ময়মনসিংহ রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, এই রুটে তিস্তা এক্সপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস, অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ও যমুনা এক্সপ্রেস—এই ছয়টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেন আগে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় এই পথে আসা যাওয়া করত। কিন্তু এখন নতুন গতিসীমার কারণে বেশি সময় লাগছে। এ ছাড়া সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় দু-তিনটি করে ক্রসিং এই সময়ক্ষেপণ আরও বাড়িয়ে তোলে।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ রেলপথের দূরত্ব মাত্র ১২৪ কিলোমিটার। অথচ আপ অথবা ডাউন পথে এটুকু পথ অতিক্রম করতে চার থেকে ছয় ঘণ্টা করে সময় নিচ্ছে একেকটি আন্তনগর ট্রেন। গড় হিসাবে ৩০ কিলোমিটার কিংবা এর চেয়েও কম গতিতে চলছে। এক সপ্তাহ ধরে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে দেরিতে ট্রেন চলাচলের এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। এই বিলম্বের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলসংশ্লিষ্ট চালক, গার্ড ও স্টেশন সুপার—সবাই বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক আরোপকৃত নতুন গতিসীমার কথা উল্লেখ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ সেকশনে বর্তমানে ঢাকার কমলাপুর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার। তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর ৫০, বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী ১০, টঙ্গী থেকে ধীরাশ্রম ৪০, ধীরাশ্রম থেকে জয়দেবপুর ৫০, জয়দেবপুর থেকে শ্রীপুর ও গফরগাঁও হয়ে উমেদনগর পর্যন্ত ৪০ এবং উমেদনগর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে ফাতেমানগর, আউলিয়ানগর এবং মশাখালী স্টেশনের কিছু অংশে ‘ডেড স্টপেজ’ থাকায় সে স্থানগুলোতে ১০ কিলোমিটার গতি নির্ধারণের ফলে গতি কমিয়ে ধীরগতিতে চলে প্রতিটি ট্রেন। এ ছাড়া বিমানবন্দর ও গফরগাঁও স্টেশনে সব ট্রেন দুই মিনিট যাত্রাবিরতি করে।

গতকাল বুধবার থেকে রেলওয়ে সেবা সপ্তাহ শুরু হলেও সেদিনই তিস্তা এক্সপ্রেস ৪০ মিনিট এবং অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ২ ঘণ্টা দেরিতে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছায়। আর যমুনা এক্সপ্রেস রাত ৯টা ১৫ মিনিটে এবং ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস পৌঁছেছিল রাত ১০টা ১০ মিনিটে। অথচ এই ট্রেন দুটোর ময়মনসিংহে পৌঁছানোর সঠিক সময় যথাক্রমে রাত ৮টা ১০ এবং রাত ৯টা ৫ মিনিট। এভাবে প্রতিদিনই গড়ে এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় বেশি নিয়ে চলছে এই আন্তনগর ট্রেনগুলো। আজও একই অবস্থা ছিল।

এই অবস্থায় ট্রেন যাত্রীরা রেলের আধুনিকায়নের দাবি জানান। আবু সালেহ নামের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসের এক যাত্রী বলেন, ‘বিশ্বে যেখানে গতিবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় দিনদিন প্রযুক্তি আধুনিক হচ্ছে, সেখানে আমরা উল্টো গতি কমিয়ে মান্ধাতা আমলে ফিরে যাচ্ছি।’

যমুনা এক্সপ্রেসের আরেক যাত্রী নুরুল আফসার বলেন, এই লাইনটি অনেক পুরোনো, তাই লাইন সংস্কার করে এই পথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি জরুরি। এই আধুনিক যুগেও গড়ে ৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলা হাস্যকর বলে মনে করেন তিনি।

আর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রেনচালকের ভাষ্য, দুর্ঘটনারোধে রেল কর্তৃপক্ষ এই গতিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাই তাঁরা সেই নিয়ম অনুসরণ করেই ট্রেন চালাচ্ছেন। তাঁরা স্বীকার করেন, নতুন গতিসীমার জন্য ট্রেন চালাতে অতীতের তুলনায় বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে। তাঁদের এই গতিসীমা লঙ্ঘন করে ট্রেন চালানোর সুযোগ নেই, কারণ কেউ অতিরিক্ত গতিতে ট্রেন চালালে সেটি জিপিআরএস রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এ জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের স্টেশন সুপারিন্টেন্ডেন্ট জহুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এই গতিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে ট্রেন লাইনচ্যুতিসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম। ট্রেন চলাচলে কিছুটা সময় বেশি ব্যয় হলেও যাত্রীরা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

আর রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সুকুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, এই রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা ও স্লিপার খারাপ হয়ে যাওয়ায় ট্র্যাকের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাই তাঁরা কম গতিতে ট্রেন চালানোর সুপারিশ করেছেন। তবে লাইনের সংস্কারে চাহিদাপত্র দেওয়া আছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে সংস্কারকাজ করে ট্রেন চলাচলের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।