আইন ভেঙে প্রায়ই জেলে ঢোকেন সাংসদ হাজারী

সাংসদ নিজাম হাজারী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সাংসদ নিজাম হাজারী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ফেনী কারাগারের নিরাপত্তা সেলে ঢুকে যুবলীগের দুই নেতাকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে তদন্ত কমিটি ভয়ংকর তথ্য পেয়েছে। তা হলো, সাংসদ নিজাম হাজারী আইন লঙ্ঘন করে নিয়মিত কারাগারে যেতেন, এখনো যান। সাংসদকে কারাগারের ভেতরে নিয়ে যেতেন জেল সুপার।

সেলে রাখা হয় সাজাপ্রাপ্ত বা দুর্ধর্ষ আসামিদের। কিন্তু যুবলীগের ওই দুই নেতা সাজাপ্রাপ্ত নন, সাধারণ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের সেখানে রাখা হয়েছিল। এই দুই নেতা ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এম আজহারুল হক ও জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া গত ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিবের (সেবা সুরক্ষা বিভাগ) কাছে অভিযোগ করেন, তাঁদের ফেনী কারাগারে নিরাপত্তা সেলের ৩ নম্বর কক্ষে রাখা হয়েছে এবং সাংসদের লোকজন সেখানে ঢুকে তাঁদের হুমকি দিয়েছেন।

তদন্ত কমিটিকে একজন সাক্ষী বলেছেন, সাংসদ তাঁর দেহরক্ষী সাহাবুদ্দিন ও ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন মজুমদারকে নিয়ে কারাগারের ভেতরে গেছেন।

যুবলীগের দুই নেতা লিখিত অভিযোগে জানান, গত ১৩ এপ্রিল বেলা সাড়ে তিনটায় সেলে প্রবেশ করেন হারুন মজুমদার ও সাহাবুদ্দিন। তাঁরা তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোদের মামলা কয়টি? তোরা কোনো মামলায় জামিন করাবি না। জামিন করালে জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর তোদের একরাম চেয়ারম্যানের মতো পুড়িয়ে হত্যা করা হবে।’ এরপর ৫ জুন দুপুর ১২টায় এস আলম সবুজ এবং ফেনী সদর থানার উপপরিদর্শক নজরুল ইসলাম সেলের ৩ নম্বর কক্ষে ঢুকে সাখাওয়াতকে হুমকি দিয়ে বলেন, কারাগার থেকে বের হয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

এ অভিযোগের পর গত ১৩ এপ্রিল ইউপি চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মধ্যস্থতা করতে আমরা এমপির (নিজাম হাজারী) সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম।’

কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাত দিয়ে তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, নিজাম হাজারী নিয়মিত কারাগারের ভেতরে যান। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৩ এপ্রিল, ৫ জুন তিনি কারাগারে ঢুকেছেন। গত বছরের ২৩ আগস্টও তাঁর কারাগারে প্রবেশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইন অনুযায়ী তিনি এভাবে কারাগারের ভেতরে যেতে পারেন না।

জানতে চাইলে নিজাম হাজারী কারাগারে নিয়মিত ঢোকার বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল রাতে প্রথম আলোকে ফোনে বলেন, স্থানীয় সাংসদ চাইলেই তাঁর নির্বাচনী এলাকার কারাগারে যেতে পারেন। এ জন্য তাঁকে অনুমতি নিতে হয় না। কারাবন্দীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার জন্যও সেখানে তাঁকে যেতে হয়। তবে সাংসদ চাইলে জেল সুপারকে অবহিত করতে পারেন।

দুই নেতাকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে নিজাম হাজারী বলেন, ‘এদের হুমকি দেওয়ার কী আছে? আমি সাংসদ, আবার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তাহলে কেন তাদের হুমকি দেব?’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদ কেন, কোনো মন্ত্রীও অনুমতি ছাড়া কারাগারের ভেতরে ঢুকতে পারেন না। আমি যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমিও পারব না। আমাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কারাগারে ঢুকতে হবে।’

>যুবলীগের দুই নেতাকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে।

তদন্ত কমিটিকে সাক্ষীরা যা বলছেন
ফেনী কারাগারের জ্যেষ্ঠ সুপার রফিকুল কাদের তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, আইনানুযায়ী সাংসদের কারাগারে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। তবে তিনি বেশ কয়েকবার ঢুকেছেন। ওই দিন তিনি চুল কাটতে বাইরে ছিলেন। সাংসদ ঢোকার পর তাঁকে জানানো হয়েছে।

জেল সুপার বাইরে থাকলেও তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেন, সাংসদ কাউকে হুমকি দেননি। কাউকে নিয়েও ঢোকেননি। নিরাপত্তা সেলে ফাঁসির আসামিদের রাখার বিষয়ে জেল সুপার বলেন, নিরাপত্তার জন্য ওই দুই আসামিকে সেলে রাখা হয়েছিল।

জেলার দিদারুল আলম অবশ্য বলেছেন, তাঁর ২৮ বছরের কর্মজীবনে কোনো সাংসদকে এভাবে জেলখানায় ঢুকতে দেখেননি। তবে জেল সুপারের নির্দেশেই তিনি গেট খুলে দিয়েছেন। টেলিফোনে জেল সুপারের নির্দেশেই তিনি ও ডেপুটি জেলার মনির হোসেন সাংসদকে কারা অভ্যন্তরে ঢুকিয়েছেন। তিনি আরও জানান, নিজাম হাজারী বেসরকারি কারা পরিদর্শক না হয়েও প্রায়ই কারাগারে ঢোকেন। তাঁর সাত মাসের দায়িত্ব পালনকালে এই সাংসদ তিনবার কারাগারে ঢুকেছেন। ১৩ এপ্রিল নিজাম হাজারী ২টা ৩৫ মিনিটে কারাগারে ঢোকেন, বের হন ৩টা ২৫ মিনিটে।

জেলার বলেন, সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া ও আজহারুল ইসলাম বিচারাধীন মামলার আসামি। তাঁদের সেলে রাখা হয়েছিল। সাধারণত সেলে সাজাপ্রাপ্ত ও দুর্ধর্ষ শ্রেণির আসামিদের রাখা হয়। এই দুজন দুর্ধর্ষ ছিলেন না। সাধারণ ওয়ার্ড থেকে সেলে দেওয়ার এখতিয়ার জেল কোড অনুযায়ী জেল সুপারের। এই দুজন আসামিকে সেলে দিয়েছেন জেল সুপার।

যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, সেলে গিয়ে তাঁকে হুমকি দেন সাংসদের দেহরক্ষী ও ইউপি চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার।