ভারতে ট্রেন থেকে নিখোঁজ শিক্ষকের খোঁজ মেলেনি

শিক্ষক রেজওয়ান হোসেন।  ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষক রেজওয়ান হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় তিন মাস আগে চিকিৎসা ভিসা নিয়ে ভারতে যান জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের থল গ্রামের বাসিন্দা ও মোসলেমগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজওয়ান হোসেন (৩৬)। সেখানে চলন্ত ট্রেন থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। আজও পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস মেলেনি।

রেজওয়ানের হদিস পেতে তাঁর সহায়তাকারী (স্ত্রীর বড় ভাই) সাহারুল ফারুক প্রায় আড়াই মাস ধরে স্টেশন থেকে স্টেশনে, ভারতের রেলওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন কার্যালয়, মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়, রাজ্যপাল, পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে দিনের পর দিন ছোটাছুটি শেষে হতাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। কলকাতার বিভিন্ন দৈনিকে নিখোঁজ রেজওয়ানের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে পুলিশ বিভিন্ন রেলস্টেশনে রেজওয়ানের সন্ধান চেয়ে ছবিসহ পোস্টারও সেঁটেছে। কিন্তু হদিস মেলেনি রেজওয়ানের। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও একটি মেয়েসন্তান রয়েছে। তিন মাসেও খোঁজ না মেলায় উদ্বিগ্ন তাঁর পরিবার।

রেজওয়ানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানসিক সমস্যার কারণে দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের ওষুধ সেবন করেন রেজওয়ান। এ কারণে বছর দুয়েক আগে রেজওয়ানের লিভারজনিত জটিলতা ধরা পড়ে। বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা বছরখানেক আগে তাঁর লিভারে অস্ত্রোপচারও করেন। অস্ত্রোপচারের পরও সুস্থ না হওয়ায় চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৭ মে এবং ১৬ আগস্ট তিন দফায় রেজওয়ানকে নেওয়া হয় ভারতের হায়দরাবাদের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে। সেখানে চিকিৎসার পর লিভারের সমস্যা সেরে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

রোগীর সহায়তাকারী (অ্যাটেনডেন্ট) হিসেবে প্রথম থেকেই ভারতে চিকিৎসার যাবতীয় বিষয়ে সহযোগিতা করে আসছেন সাহারুল ফারুক। তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা বেড়ে গেলে চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রেজওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সের উদ্দেশে হিলি চেকপোস্ট হয়ে রওনা দেন। বালুরঘাট রেলস্টেশন থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ট্রেনে ওই দিন দুপুরের দিকে তাঁরা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন। আটজনের একটি রিজার্ভেশন কামরায় তাঁরা দুজন ছাড়া আরও ছয় যাত্রী ছিলেন। রাত ১২টায় মালদহ স্টেশনে খাবার খেয়ে রেজওয়ান ট্রেনের কামরায় ঘুমিয়ে পড়েন। সাহারুলও কামরার আরেকটি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন। পাসপোর্ট তাঁর পকেটেই ছিল।

সাহারুল ফারুক বলেন, দমদম ও নৈহাটি স্টেশন ছেড়ে আসার পর তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। আর মাত্র দুটি স্টেশনের পরই শিয়ালদহ স্টেশন। এ জন্য নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি দেখেন ট্রেনের কামরায় যেখানে রেজওয়ান ঘুমিয়ে ছিলেন, সেখানে তিনি নেই। এরপর তিনি পুরো ট্রেন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রেজওয়ানের সন্ধান পাননি। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছার পরপরই তিনি রেলওয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানান। বিভিন্ন স্টেশনে খোঁজখবর করেও সন্ধান না পাওয়ায় ২০ সেপ্টেম্বর শিয়ালদহ রেলওয়ে থানায় গিয়ে তিনি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। থানা ছাড়াও হাসপাতাল, মর্গসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর করে রেজওয়ানের হদিস পেতে ব্যর্থ হন তিনি। রেজওয়ানের সন্ধান চেয়ে ছবিসহ বিভিন্ন স্টেশনে পোস্টারও সাঁটে পুলিশ। ২৩ সেপ্টেম্বর ও ২৯ অক্টোবর কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনারের কার্যালয়ে দুই দফা আবেদন করেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো সাড়া না পেয়ে ২৫ অক্টোবর প্রথমে রাজ্যপালের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেন সাহারুল। ৩১ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে আরেকটি আবেদন করেন সাহারুল ফারুক। একই দিন কলকাতার বিধাননগরে মানবাধিকার কমিশনেও রেজওয়ানকে খুঁজে বের করতে সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করা হয়। এ ছাড়া ৪ নভেম্বর সিআইডির উপমহাপরিদর্শকের কাছে আরেকটি আবেদন করেন।

দীর্ঘ দুই মাস ধরে ছোটাছুটির পরও রেজওয়ানের হদিস না পাওয়ায় গত ২৬ নভেম্বর ভারতীয় নানা দপ্তরে আবেদনের সব অনুলিপিসহ ভারতীয় উপ–হাইকমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে আরেকটি আবেদন করেন সাহারুল। সাহারুলের এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সাহারুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ভারতে থাকার মতো টাকা ছিল না। রাতের পর রাত স্টেশনে কাটিয়েছি। দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছি। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে একা দেশে ফিরেছি।’

রেজওয়ানের স্ত্রী সুরভী আকতার প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান রেজওয়ান। শিক্ষার্থী-সহকর্মীরা তাঁর খোঁজখবর করছেন। ফিরে না এলে চাকরিও থাকবে না। পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আড়াই বছরের মেয়ে তার বাবার জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে। তিনি রেজওয়ানকে খুঁজে বের করতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।