করুণার 'স্বপ্নের' টিনের ঘর

কয়রার করুনা বালার নতুন ঘর।  ছবি: প্রথম আলো
কয়রার করুনা বালার নতুন ঘর। ছবি: প্রথম আলো

তালপাতা দিয়ে কোনো রকম ঘেরা একটি ছোট ঝুপড়ি। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পলিথিন। ওই ঘরের মধ্যেই মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ষাটোর্ধ্ব করুণা বালা। ভিক্ষা করে এনে দিতেন ভাইয়ের ছেলের হাতে। দিনমজুর সেই ভাইপো কিছু খাবার দিলে মুখে খাবার জুটত তাঁদের।

রাতারাতি বদলে গেছে করুণা বালার ওই ঘর। তালপাতার বেড়া খুলে লাগানো হয়েছে রঙিন টিন। পলিথিনের ছাউনির পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে টিনের ছাউনি। নতুন ওই ঘর পেয়ে খুশি করুণা বালাও। তিনি বলেন, ‘এত দিন পর ভগবান মুখ তুলি তাকায়ছে। এখন একটু ভালো ঘরে থাকতি পারব।’

করুণা বালার বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার ৩ নম্বর কয়রা গ্রামের ক্ষত্রিয়পাড়ায়। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে করুণা বালার ওই করুণ কাহিনির কথা জানতে পারেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা। শুক্রবার তিনি তাঁর ব্যক্তিগত খরচ থেকে করুণা বালার ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ওই দিন দুপুর থেকেই ঘরের কাজ শুরু হয়। রোববার বিকেলের মধ্যেই তৈরি হয় করুণা বালার স্বপ্নের টিনের ঘর।

গত রোববার দুপুরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. জাফর রানাকে নিয়ে ওই করুণার বাড়িতে যান ইউএনও। সেখানে গিয়ে নিজ হাতে ওই তাঁকে খাইয়ে দেন। ইউএনও তাৎক্ষণিকভাবে করুণা বালা ও তাঁর সন্তানকে দেখাশোনার জন্য তাঁর ভাইয়ের ছেলে জিতেন চন্দ্রকে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

ঘর পেয়ে করুণা বালার মুখে ভেসে গেছে হাসির বন্যা। উপস্থিত অনেকের চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। বৃদ্ধের শরীর নিজের মায়ের মতো করে জাপটে ধরেন শিমুল কুমার সাহা। তিনি নিজেই মুখে খাবার তুলে দেন অসুস্থ করুণার। তাঁর এই মানবিকতা দেখে গ্রামের সবাই হতভম্ব হয়ে যান।

তাৎক্ষণিক সহযোগিতা হিসেবে ইউএনও পরিবারটির জন্য ১০ কেজি চাল, ডাল, তেলসহ করুণা বালার জন্য শাড়ি ও তাঁর সন্তানের জন্য লুঙ্গি, গামছা কিনে দেন।

বৃহস্পতিবার পেশাগত কাজে ওই বৃদ্ধের বাড়ি গিয়েছিলেন কয়রার স্থানীয় সাংবাদিক ইমতিয়াজ উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে করুণা বালার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভাঙাচোরা অন্ধকার খুপরির মধ্যে কোনো রকমে মাথা গুঁজে পড়ে আছেন করুণা বালা ও তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে চণ্ডীদাশ। ঘরের ভেতর মলমূত্রের দুর্গন্ধ। চণ্ডীদাশ অর্ধ–উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছেন খাটের ওপর। আর খাটের পাশে মাটিতে এক টুকরা গামছা গায়ে জড়িয়ে পড়ে আছেন মা করুণা বালা।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্তান ছোট থাকতেই করুণা বালাকে রেখে নিরুদ্দেশ হন স্বামী সুরাজ মণ্ডল। সেই থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে চণ্ডীদাসকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইটা একাই করে যাচ্ছেন তিনি।

প্রথম দিকে অন্যের বাড়িতে কাজ করলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতা জেঁকে বসে করুণা বালার শরীরে। এরপর থেকে পেটের দায়ে মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা করতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু ছয় মাস ধরে একেবারেই উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। ভাইয়ের ছেলে জিতেন চন্দ্র তাঁর ঘরে খাবার দিয়ে যান। অনাহারে, অর্ধাহারে, অভাব-অনটনে জীবন পার করে আসছেন দুজনে।

করুণা বালার ভাইয়ের ছেলে হতদরিদ্র দিনমজুর জিতেন চন্দ্রের পরিবারেও রয়েছে ছয় সদস্য। নিজের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। তারপরও করুণা বালা ও তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানকে যেটুকু পারেন খেতে দেন তিনি।

জিতেন চন্দ্র বলেন, সংসার চালাতে দিনমজুরি করেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে করুণা বালা ও তাঁর ছেলেকে লালনপালন করে গেছেন। প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। যেদিন কাজ পাওয়া যায় না, সেদিন আর তাঁদের খেতে দিতে পারেন না।

করুণা বালার মুখে হাসি ফুটিয়ে খুশি ইউএনও। তিনি বলেন, ‘যতটুকু পেরেছি নিজ থেকেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। মানুষের বিপদের সময় পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটা প্রাণ বাঁচে, একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাতেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।’ মানবজীবনের সম্পূর্ণতা আর তৃপ্তির জন্য বিত্তবানদের প্রতি সমাজের অসহায়-নিপীড়িত মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ দেন তিনি।