সু চি 'মিথ্যুক', বললেন রোহিঙ্গারা

আইসিজেতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও এজেন্ট অং সান সু চি। দ্য হেগ, নেদারল্যান্ডস, ১১ ডিসেম্বর। ছবি: রয়টার্স
আইসিজেতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও এজেন্ট অং সান সু চি। দ্য হেগ, নেদারল্যান্ডস, ১১ ডিসেম্বর। ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) সু চি মিথ্যাচার করেছেন বলে দাবি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। আজ বুধবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বক্তব্য দেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি।

সু চি বলেছেন, তাঁর দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই। আদালতে গাম্বিয়ার দেওয়া বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর এবং রাখাইনে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে সংঘাতের ফল হিসেবে অভিহিত করেন অং সান সু চি।

সু চির এমন বক্তব্যে হতাশ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গারা। তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং অং সান সু চিকে ‘মিথ্যুক’ বলে অভিহিত করেন। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় রোহিঙ্গারা কোনো শিবিরে বিক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারেননি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।

গতকাল মঙ্গলবার অং সান সুচির উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা গণহত্যার (মানবতাবিরোধী নৃশংসতার) সারাংশ তুলে ধরেন আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। তিনি বলেন, বিশ্ববিবেকের কালিমা মোচনে আর দেরি করা চলে না।

গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আরও বলেন, একমাত্র এই আদালতই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, আশা জাগাতে পারে। আইসিজে মিয়ানমারকে বলুক যে এখনই রোহিঙ্গা শিশুদের হত্যা বন্ধ করতে হবে, নৃশংসতার অবসান ঘটাতে হবে।

গাম্বিয়ার এমন বক্তব্যকে স্বাগত জানায় রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ)–এর একজন মুখপাত্র বলেন, সু চি এবারও মিথ্যাচার করলেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি কখনোই সম্ভব নয়। এতে ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। সু চি বক্তব্য রোহিঙ্গারা প্রত্যাখ্যান করেছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখার একটি আশ্রয়শিবিরে দুই বছর ধরে অবস্থান করছেন ১ হাজার পরিবারের প্রায় ৪ হাজার রোহিঙ্গা। আজ সকাল থেকে বাসিন্দাদের দৃষ্টি ছিল আন্তর্জাতিক আদালতের দিকে, রোহিঙ্গা গণহত্যার ব্যাপারে অং সান সু চি কী বলেন। বিকেলে সুচির বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হলে রোহিঙ্গারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অং সান সু চির বক্তব্য শুনতে চায়ের দোকানে টেলিভিশনের সামনে রোহিঙ্গাদের ভিড়। জাদিমোরা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির, টেকনাফ, কক্সবাজার,১১ ডিসেম্বর। ছবি: প্রথম আলো
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অং সান সু চির বক্তব্য শুনতে চায়ের দোকানে টেলিভিশনের সামনে রোহিঙ্গাদের ভিড়। জাদিমোরা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির, টেকনাফ, কক্সবাজার,১১ ডিসেম্বর। ছবি: প্রথম আলো

এই শিবিরের মাঝি (নেতা) দীল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুচির বক্তব্যে আমরা (রোহিঙ্গারা) হতাশ হইনি। কারণ, তিনি (সু চি) মিথ্যুক। শুরু থেকেই তিনি রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে মিথ্যা বলে আসছেন। তবে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা অনেক। আশা করছি, রায় রোহিঙ্গার পক্ষে যাবে। রায় পক্ষে এলে আমরা তিন-চার মাসের মাথায় জন্মভূমিতে (রাখাইনে) ফিরে যেতে পারব।’

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবিরটির অবস্থান। একটি পাহাড়ি খাল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত ভাগ করে দিয়েছে। খালের পূর্ব প্রান্তে শূন্যরেখায় শিবিরটি দাঁড়িয়ে আছে। শিবিরের পেছনে মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার কাছেই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের একাধিক নিরাপত্তাচৌকি এপার থেকে দেখা যায়। রোহিঙ্গারা থাকেন কড়া নজরদারিতে।

এই শিবিরের আরেক নেতা মো. আরিফ উল্লাহ বললেন, এই শিবিরের পেছনে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাখাইন রাজ্য। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সেখানকার সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে অন্তত ১০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছে। বর্বর অত্যাচার নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে তাঁরা অন্তত পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে না গিয়ে শূন্যরেখার এই শিবিরেই পড়ে আছেন। আইসিআরসি রোহিঙ্গাদের চাল, ডাল, তেল, লবণসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দিলেও সময় কাটছে চরম আতঙ্কে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পক্ষে এলে এই শিবিরের রোহিঙ্গারা দল বেঁধে রাখাইনে ফিরে যাবে।

এই শিবিরের রোহিঙ্গা আনজুম আরা বললেন, ‘সুকি মিথ্যুক। তাঁর হতার হন বিশ্বাস নাই। সুকির শাস্তি অন দরহার।’ (সু চি মিথ্যুক। তাঁর কথার কোনো বিশ্বাস নাই। তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত)।

এআরএসপিএইচের কর্মকর্তারা বলছেন, অং সান সূ চি আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেই বলবেন—এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তিনি গাম্বিয়া মামলার আসামি।

উখিয়ার বালুখালী শিবিরের মাঝি জাকের হোসেন বলেন, সূচি রোহিঙ্গা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলেও আন্তর্জাতিক আদালতের ওপর তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আর এ আদালত যদি মিয়ানমারের পক্ষে কথা বলেন, তাহলে ধরে নিতে হবে পৃথিবীতে সত্য বলে কিছু নেই।

টেকনাফের শালবাগান শিবিরের নারী চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি মিথ্যুক, সেটা আবার প্রমাণ করলেন। আন্তর্জাতিক আদালতেও মিথ্যা অজুহাতে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন সু চি।

গতকাল উখিয়ার জামতলী শিবিরের রোহিঙ্গারা সংক্ষিপ্ত মানববন্ধন-সমাবেশ করে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।