গণপূর্তে এসে তিন বছর বেতনই তোলেননি তিনি

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র শাখা প্রধান মুমিতুর রহমান
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র শাখা প্রধান মুমিতুর রহমান

গত তিন বছরে ব্যাংকে জমা হওয়া বেতন-ভাতার টাকা একবারও তোলেননি তিনি। তবে গত সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে–পরে ব্যাংকের ওই হিসাব থেকে প্রায় পুরো টাকাটাই তুলে নিয়েছেন। তাঁর আরেকটি ব্যাংক হিসাবে নিয়মিতভাবেই এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা জমা হয়েছে। প্রায় ৩৪ লাখ টাকা জমা হওয়ার পর হঠাৎ করেই সেখান থেকে প্রায় পুরো টাকাই তুলে নিয়েছেন তিনি।

এই ব্যক্তি একজন সরকারি কর্মকর্তা। নাম মুমিতুর রহমান। কাজ করেছেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র শাখাপ্রধান হিসেবে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি বদলি হয়ে এখানে যোগ দেন। মূলত, তিনি ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা। 

মুমিতুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন আক্তার একজন গৃহিণী। আয়কর নথির হিসাবে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাঁর আয়কর নথিতে সম্পদ বেড়েছে ৫৩ লাখ টাকার। এ আয় এসেছে মৎস্য চাষ ও কৃষি আয় থেকে। আয়কর নথিতে ব্যাংক ও হাতে নগদ অর্থ ২৭ লাখ টাকা আছে উল্লেখ করা হলেও ব্যাংকে তাঁর জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি টাকা। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

আয়কর নথির তথ্য অনুসারে বর্তমানে মুমিতুর রহমানের মূল বেতন ৪৯ হাজার ৯০ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তাঁর মোট আয় ১০ লাখ ১৫ হাজার ৬১৮ টাকা। সেখানে দেওয়া তথ্যমতে, তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার টাকার।

তবে আয়কর নথির সম্পদবিবরণীতে তিনি বলেছেন, গ্রামের বাড়িতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ বিঘা জমির ওপর তিনটি টিনশেড ঘর আছে, যার দাম তিনি জানেন না। ৫৮ লাখ টাকার ফ্ল্যাট, সোয়া সাত লাখ টাকায় কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে ৭ শতাংশের বেশি জমি, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্লট কেনা বাবদ ২৪ লাখ টাকা, ৩৩ লাখ টাকারও বেশি টাকায় আড়াই বিঘা ধানি জমির কথা উল্লেখ আছে তাঁর আয়কর নথিতে।

মুমিতুরের ব্যাংক হিসাবগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংকের শেরেবাংলা নগর শাখায় মুমিতুরের বেতন-ভাতার টাকা জমা হতো। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই হিসাব থেকে মাত্র একবার দুই লাখ টাকা তুলেছেন। ২০১৯ সালের ১০ জুন ওই হিসাবে টাকার স্থিতি দাঁড়ায় ২৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা। শুদ্ধি অভিযান শুরুর আগে পরে তিনি ওই হিসাব থেকে ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে নেন। বিএফআইইউ লেনদেন স্থগিত করার পর ওই হিসাবে জমা আছে ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা।

মুমিতুরের স্ত্রী জেসমিন আক্তারের আয়কর নথি অনুসারে, তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকার। এক বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৫৩ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫০ টাকার। নথি অনুসারে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় দশমিক শূন্য ৪৯৭ একর জমি, যার দাম ১২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা, পাবনার ঈশ্বরদীতে দশমিক ২৮ একর জমি যার দাম সাড়ে ১৪ লাখ টাকা, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি যার দাম ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার। এ ছাড়া ৫০ তোলা স্বর্ণ আছে, যার দাম জানা নেই।

আয়কর নথির হিসাবেরও বাইরে তাঁর বিপুল অর্থ আছে বিভিন্ন ব্যাংকে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, পূবালী ব্যাংকের ভেড়ামারা শাখায় স্থায়ী আমানত (এফডিআর), সঞ্চয়ী ও চলতি হিসাবে জমা আছে প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ব্র্যাক ব্যাংকের ভেড়ামারা শাখায় বিভিন্ন হিসাবে জমা আছে ৮০ লাখ টাকা। তাঁর নামে থাকা স্ল্যাশ ডিজিটাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্র্যাক ব্যাংকের আসাদগেট শাখায় জমা আছে ৩২ লাখ টাকা।

বিএফআইইউ সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, মুমিতুর ও তাঁর স্ত্রীর ওই সব ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে।

চলমান শুদ্ধি অভিযান শুরুর পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে যে অনুসন্ধান শুরু করে, তার প্রথম তালিকাতেই মুমিতুর রহমানের নাম আছে। দুদক যে ৩৪ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার মধ্যে মুমিতুরও আছেন।


আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, মুমিতুর সরকারি কর্মকর্তা হলেও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ঠিকাদারদের কাছে গ্রেপ্তার হওয়া ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীমের মুখে মুমিতুরের নাম বেরিয়ে আসে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় মুমিতুর ছিলেন খুবই বেপরোয়া। তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন ২০১৬ সালের মার্চে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মুমিতুর বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

মুমিতুর পরিকল্পনা শাখায় কাজ করলেও উন্নয়ন শাখার বিভিন্ন কাজের দেখাশোনা করছেন। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন সব উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ফাইল আসত তাঁর টেবিলে। ফলে খুব অল্প সময়েই জিকে শামীমের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় তাঁর। এই সময় মন্ত্রণালয়ের ভেতরে শামীমের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। শামীমের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে তাঁর জীবনধারাও পাল্টে যায়। ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যান তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁর আর্থিক অবস্থা এতই পরিবর্তন হয়ে যায় যে চাকরির বেতনে হাতই দিতেন না তিনি। ওই আয়ের একটি বড় অংশ নিজের স্ত্রীর নামে জমা করেছেন।

মুমিতুর ও তাঁর স্ত্রীর আয়কর নথি ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুমিতুরের স্ত্রী জেসমিন যে আয় দেখিয়েছেন, তার জন্য ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন। একজন গৃহিণীর এই আয়ের তথ্য পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

এ বিষয়ে জানতে মুমিতুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর দপ্তরে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

মুমিতুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই মামলা হবে এই দম্পতির বিরুদ্ধে।