কেরানীগঞ্জে অবৈধ কারখানার তালিকা তৈরির উদ্যোগ, পাঁচ কারখানা সিলগালা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যুর পর উপজেলা প্রশাসন অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। আজ শুক্রবার ও গতকাল বৃহস্পতিবার তারা পাঁচটি কারখানা সিলগালা করেছে। একই সঙ্গে প্রশাসন কেরানীগঞ্জে অবৈধ কারখানার তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে।

গত বুধবার বিকেলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা এলাকার প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানাটিতে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে একজন ঘটনাস্থলে এবং ১২ জন হাসপাতালে মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ১৮ জনের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।

এ ঘটনায় নিহত ১৩ জনের একজন আলম। তাঁর ভাই মো. জাহাঙ্গীর প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক নজরুল ইসলামসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন।

আজ সকালে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের পাশে একই মালিকের একটি প্যাকেজিং কারখানা ও গুদামঘর সিলগালা করে দেয়। এতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও পুলিশ অংশ নেয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই এলাকার একটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট সিলগালা করে দেন। কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক পলাশ হোসেন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তাঁকে আটক করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত কেরানীগঞ্জের সুভাঢ্যায় আসামি নজরুল ইসলামের আরেকটি অবৈধ প্লাস্টিক কারখানায় তালা লাগিয়ে দেন। ওই দিন কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় দুটি অবৈধ কারখানাও সিলগালা করে দেওয়া হয়।

আগে অভিযান চালাননি কেন এবং চুনকুটিয়ায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরই অভিযান চালানোর পরই উদ্যোগ নিলেন কি না, জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবেই অভিযান চালানো হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় কারখানা থাকার নিয়ম নেই। তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসন এখন অবৈধ কারখানার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। এরপর এসব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসান বলেন, আগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস যে যার মতো অভিযান চালাতো। এখন প্রশাসন সবার সমন্বয় করে অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাবে।

আজ সকালে ঢাকা জেলার প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার আগে কারখানাগুলো কী ধরনের, তা যাচাই করে নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

এতগুলো মৃত্যুর পর চুনকুটিয়ায় এখন শোকের আবহ বইছে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ফটকে পুলিশের পাহারা। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানায় ঢুকতেই পোড়া ঝাঁজালো গন্ধ ভেসে আসে। আগুনে কারখানার টিনের ছাপড়া দুমড়ে মুচড়ে গেছে। প্লাস্টিকের পণ্য সামগ্রী পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ হয়ে আছে। কয়েকটি গ্যাসের ছোট সিলিন্ডারের পুড়ে কালো হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেটি ফেটে গেছে। কারখানার সামনে বেশ কিছু গ্যাসের সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে।

কারখানার নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার ভেতর বয়লারের পেছনে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হতো। সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হওয়ার পরই আগুন ধরে যায়। নিরাপত্তাকর্মীরা প্রথমে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। আগুন দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় কর্মীরা আটকা পড়েন এবং দগ্ধ হন।

কারখানা ঘেঁষে তিন তলা বাড়ির মালিক আবদুল মজিদ বলেন, তিন বছর আগে তিনি যখন বাড়ি নির্মাণ করেন তখন এখানে কারখানা ছিল না। নজরুল টিনশেড করে ভাড়া দেন। পরে ভাড়াটেদের সরিয়ে দিয়ে নজরুল প্লাস্টিক কারখানা করলে তিনি বাধা দিতে গেলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নজরুল ৫৪ শতাংশ জমির ওপর প্লাস্টিকের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখা তার বাড়ি ছুঁই ছুঁই করছিল। এ অবস্থায় তার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যান। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় ঘটনার পর থেকে তারা পানি তুলতে পারছেন না।

চুনকুটিয়ায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা কারখানা মালিকের বিচার দাবি করেন। তারা বলেন, এর আগে একাধিকবার কারখানায় আগুন লাগলেও প্রশাসন নজরুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুনকুটিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের পর উপজেলা প্রশাসন এখন কেরানীগঞ্জে আবাসিক এলাকাসহ সব অবৈধ কারখানার তালিকা করার কাজ শুরু করেছে। একই সঙ্গে অভিযানও শুরু করে।

এদিকে আজ বিকেল তিনটার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর এলাকায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নিজস্ব বাসভবনে গত বুধবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় নসরুল হামিদ বলেন, কোনো অবস্থাতেই আবাসিক এলাকায় কলকারখানা গড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। এখনো যে সমস্ত আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা রয়েছে সেগুলো অবিলম্বে সরিয়ে নিতে হবে। সরকারি নির্ধারণকৃত কেরানীগঞ্জের নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল এলাকায় শিল্প কারখানা পরিচালনা করতে হবে। বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে এবং ঝুঁকিবিহীনভাবে শিল্প কারখানা পরিচালনা করতে হবে।

প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা

অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া আলমের ভাই মো. জাহাঙ্গীরের করা মামলায় প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক নজরুল ইসলামসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় দণ্ডবিধি ৩০২, ৩০৭ ও ৩২৬ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, কারখানায় অপরিহার্য ব্যবস্থা না নিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে জেনেও কারখানা মালিক নজরুল ইসলাম তাঁদের হত্যার উদ্দেশ্যেই ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে আসছিলেন। আর এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদার হত্যা মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর নজরুল ইসলাম পালিয়ে গেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।