'ছবিত চাইয়া দেহি আর কান্দি'

তাপস সরকার
তাপস সরকার

‘সামান্য জমি আছিল, ওডি বেইচা আমার বুকের ধনরে ভার্সিটিত পাঠাইছিলাম। ভাবছিলাম পড়াশোনা কইরা সে গাঁ-গেরামের মুখ উজ্জ্বল করব। অনেক বড় হইব। কিন্তু সবশেষ। আমার মানিক লাশ হইয়া ফিরা আইল। সেই আশা আর পূরণ হইল না। প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে তাঁরে। এহন ছবিত চাইয়া চাইয়া দেহি, আর কান্দি।’

অশ্রুসিক্ত মুখে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকারের মা অঞ্জলী সরকার। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তাপস খুন হন ক্যাম্পাসের শাহ আমানত হলের সামনে। দীর্ঘ সময় চলে যাওয়ার পরও বিচার না পেয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ তাঁর মা। তবে এখনো তিনি আশা দেখেন। তিনি বলেন, হয়তো একদিন ছেলে হত্যার খুনিদের বিচারের খবর সাংবাদিকদের কাছে শুনবেন।

২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সকাল ১০টায় বুদ্ধিজীবী চত্বরে ছাত্রলীগের দুই উপপক্ষ ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও চুজ ফ্রেন্ড উইথ কেয়ারের (সিএফসি) নেতা-কর্মীরা একসঙ্গে শ্রদ্ধা জানান। তাপস ক্যাম্পাসে আসার পর সিএফসির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পর এই দুই পক্ষের মধ্যেই বাধে সংঘর্ষ। দুই পক্ষ শাহজালাল ও শাহ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেয়। সেখানেই এক পক্ষের নেতার ছোরা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয় তাপসের বুক।

তাপসের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম বাবুল সরকার। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তাপস ছিলেন তৃতীয়।

পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকার্য

খুন হওয়ার দিন রাতেই পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অস্ত্র আইনে মামলা করে হাটহাজারী থানা-পুলিশ। এতে অজ্ঞাতনামা ৬০ জনকে আসামি করা হয়। পরদিন রাতে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা করেন তাপসের সহপাঠী হাফিজুল ইসলাম। এই মামলায় ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। এতে ছাত্রলীগের সাবেক উপসংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান ওরফে আশাকে ১ নম্বর আসামি করা হয়।

অন্যদিকে, পুলিশের করা মামলায় আশরাফুজ্জামানকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। এ হত্যার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৬ সালের ২ মে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৯ নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আশরাফুজ্জামানের ব্যবহার করা পিস্তলের গুলিতেই খুন হন তাপস। এরপর ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আশরাফুজ্জামান। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তিনি অস্থায়ী জামিন পান। এ ছাড়া এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ১৫ জন গ্রেপ্তার হন। আশরাফুজ্জামানসহ এই ১৫ জন জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

>

তাপস সরকার হত্যা মামলা
২০১৪ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পরে খুন হন তাপস সরকার
আজ শনিবার হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো

তাপসের সহপাঠী ও মামলার বাদী হাফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খুনিরা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাঁচ বছর পার হলেও বিচার শেষ হয়নি। আদৌ বিচার হবে কি না, তা জানা নেই তাঁর। অন্যদিকে তাপসের ছোট ভাই শ্রাবণ সরকার বিচার নিয়ে শঙ্কিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিচার পাই না, আমরা অসহায়। আমার বাবা দিনমজুর। বড় ভাইকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কিছুই আর হলো না। বুলেটের আঘাতে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।’

তাপস স্মৃতি সংসদের ক্ষোভ

২০১৪ সালে তাপস হত্যার পর গঠন করা হয় ‘শহীদ তাপস স্মৃতি সংসদ’। মূলত সিএফসির নেতা-কর্মীরাই এই সংগঠনের পরিচালক। তাপস হত্যার বিচার চেয়ে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে সংগঠনটি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ৯ ডিসেম্বর মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি, ৮ ডিসেম্বর মৌন মিছিল ও ৫ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দীর্ঘ সময়েও বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।

তাপস হত্যা মামলার দুই আসামি বর্তমানে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে জানান ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রেজাউল হক। তিনি বলেন, আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের দেখে তাপসের বন্ধুরা শঙ্কিত। বুয়েটের আবরার ফাহাদ ও ফেনীর নুসরাত জাহানের হত্যাকারীরা ছাড় পায়নি। তাপসের হত্যাকারীরাও ছাড় পাবে না।