স্মৃতির আলোয় মুক্তিযুদ্ধ

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে বিশেষ প্রদর্শনীর চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। গতকাল বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে বিশেষ প্রদর্শনীর চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। গতকাল বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো

ছোট্ট এক চিঠি। বাবাকে লেখা। তার শেষ লাইনগুলো হুবহু এ রকম—‘আমি ভালো আছি। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন বাংলাকে মুক্ত করতে যায়ে যদি তার এক ছেলে হারায়, তবে হাজার হাজার দুলু থাকবে আপনাদেক মা, বাবা করে ডাকার জন্য। বেশি কি। ভালোভাবে চলাফেরা করবেন। ইতি দুলু।’

১১ আষাঢ় (১৩৭৮) ভারতের বালুরঘাটের কুঠি কাচারি ক্যাম্প থেকে লিখেছিলেন রাজশাহীর পুখরিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দুলু।

দুলু লিখেছিলেন, চিঠি পাঠানো খুব অসুবিধা, তারপর পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে সে চিঠি পড়ার ভয়। তাতে পরিবারের ওপর নির্যাতন নেমে আসবে। তা সত্ত্বেও তিনি মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন তাঁর জন্য চিন্তা না করতে। আর বলেছেন তাঁদের গ্রামের যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিতে বাবা যেন উদ্যোগ নেন। দুলুর কী হয়েছিল, তা জানা যায় না। তাঁর এই চিঠি এখন সংরক্ষিত জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহ শালায়। ১৯৮৬ সালে জাদুঘর এটি সংগ্রহ করেছিল। আজ এই চিঠিসহ রণাঙ্গন থেকে লেখা ছয় মুক্তিযোদ্ধার কয়েকটি চিঠি প্রদর্শিত হবে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ প্রদর্শনীতে। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শন কক্ষে আজ বিকেল পাঁচটায় শুরু হবে প্রদর্শনী। চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ভট্টশালী কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলে চারপাশের ছবি, ভয়ংকর সব অস্ত্র, গোলা-বারুদ, মৃত মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড় এক প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যের ভেতর দিয়ে একটানে নিয়ে যাবে ৪৮ বছর পেছনে, পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ও বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিস্মরণীয় দিনগুলোতে। বিশাল কক্ষের মাঝখানে সাজিয়ে রাখা কামান, মর্টারের গোলা, মেশিনগান, যা রক্ত ঝরিয়েছে বাঙালির বুক থেকে। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল, বেয়নেটসহ বিভিন্ন অস্ত্রপাতি। এক পাশে অস্থি-করোটি। এই নাম না জানা বাংলা মায়ের সন্তানদের একাত্তরে পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করেছিল ঘাতক পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

সামনের দিকের দেয়ালের পাশ দিয়ে সাজানো রণাঙ্গন থেকে লেখা মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগময় চিঠি। তাঁদের একজন এস এম আবদুল বারী লিখেছেন, তিনি মা-বাবাকে না জানিয়ে যুদ্ধে গেছেন, কিন্তু এ জন্য যেন মা-বাবা দুঃখ না পান। ক্যাম্পে এসে দেখেছেন তাঁর মতো হাজার হাজার ছেলে এসেছেন দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। তাঁরাও কারও সন্তান। একজন অনেক কথার ফাঁকে তাঁর পালন করা খাসির কথাটি লিখতে ভোলেননি। ছোট ভাইকে বলেছেন, খাসিটিকে যেন যত্ন করে চরায়।

>

নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে জাতীয় জাদুঘর স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন বছর থেকে শুরু করবে বিশেষ কার্যক্রম।

পরিবারের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার পাঠানো চিঠি। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এটি।  প্রথম আলো
পরিবারের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার পাঠানো চিঠি। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এটি। প্রথম আলো

এক তরুণ স্বামী তাঁর স্ত্রীকে লিখেছেন, ‘আমি অনুভব করছি তুমি খুব কাঁদছ। মা খুব কাঁদছে।’ লিখেছেন স্ত্রীকে ছেড়ে এসে তাঁরও ‘অন্তর আত্মা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে’। তবে আশ্বাস দিয়েছেন অল্প দিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন ‘শোষিত জাতির পূর্ণ উদ্ধারে মুক্তি ফৌজরূপে’। এই চিঠিগুলো পড়লে নিজের অজান্তেই হয়তো চোখ ভিজে আসবে অনেকের। মনে হবে, এই মানুষগুলো সেদিন অস্ত্র হাতে ঘর থেকে ছুটে গিয়ে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন বলেই আজ আমরা গর্ব ভরে ওড়াচ্ছি লাল-সবুজের পতাকা। প্রাণভরে গাইছি—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’।

প্রদর্শনীর সমন্বয়কারী জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস বিভাগের কিপার নূর-এ নাসরিন জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪ হাজার নিদর্শন তাঁদের সংগ্রহে রয়েছে। এ থেকে বাছাই করে প্রায় ২০০টি নিদর্শন এই বিশেষ প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের চিঠি ছাড়াও আছে যুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ৯৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে নিহত বাঙালিদের মাথার খুলি, হাড়, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, আলোকচিত্র, সেই সময়ের দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার বড় ডিজিটাল প্রিন্ট, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথিতযশা শিল্পীদের আঁকা চিত্রকলা ও বিভিন্ন পোস্টার। এ ছাড়া আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় দেড় শ বই।

এই প্রদর্শনী ছাড়াও জাদুঘরের ৩৭ থেকে ৪০ পর্যন্ত চারটি স্থায়ী গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। মহাপরিচালক রিয়াজ আহম্মদ বলেন, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতেই তাঁদের এই প্রদর্শনীর আয়োজন। নতুন বছরে স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য আরও বড় কর্মসূচি শুরু হবে। নিয়মিতভাবে তাঁদের জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধের স্থায়ী গ্যালারিগুলো দেখানো হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হবে। থাকবে প্রশ্নোত্তর। প্রায় দুই ঘণ্টার কার্যক্রম। জাদুঘরই সব ব্যবস্থা করবে। এই কর্মসূচির সমন্বয়কারী জনশিক্ষা বিভাগের কিপার শিহাব শাহরিয়ার জানান, পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি স্কুলের প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। নতুন বছর থেকে প্রতি মাসে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আনা হবে। এই কর্মসূচি চলতেই থাকবে।

নতুন প্রজন্মকে জাতির চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো জানাতে হবে। দেশের বীর সন্তানেরা আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে পতাকা উড়িয়েছেন, তা বইবার দায়িত্বভার তো প্রজন্মের পর প্রজন্মের নতুন বাঙালিরই।