বিজয়ের দিনে নিভেছিল প্রাণপ্রদীপ

পেরিয়ে গেছে ৪৮ বছর। মা ভুলতে পারেননি মুক্তযোদ্ধা ছেলে আমিনকে হারানোর শোক। তাঁর কবরের পাশে অশ্রুসিক্ত বৃদ্ধা মা সাফিয়া বেগম। গতকাল আজিমপুর কবরস্থানে।  জাহিদুল করিম
পেরিয়ে গেছে ৪৮ বছর। মা ভুলতে পারেননি মুক্তযোদ্ধা ছেলে আমিনকে হারানোর শোক। তাঁর কবরের পাশে অশ্রুসিক্ত বৃদ্ধা মা সাফিয়া বেগম। গতকাল আজিমপুর কবরস্থানে। জাহিদুল করিম

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন। মেশারফের সঙ্গে তাঁর আরও দুই ভাই মনির হোসেন ও মোয়াজ্জেম হোসেনও ছিলেন তাঁর দলে। দলপতি হিসেবে মোশারফের নামেই প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার এই দলটির পরিচিতি পেয়েছিল ‘মোশারফ বাহিনী’ হিসেবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে বীরত্বের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন মোশারফ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের প্রাক্কালে তাঁরা শেষ অবস্থান নিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জে। ১৬ ডিসেম্বর তাঁদের কাছে দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর এল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাঁরা ছুটতে থাকলেন ঢাকার দিকে। তাঁদের ৪০ জনের দলটি ১৬ ডিসেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া ঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার জন্য দুটি নৌকায় ওঠেন। মোশারফরা তিন ভাইসহ দলে অর্ধেক সদস্য উঠেছিলেন এক নৌকায়। মাঝনদীতে হঠাৎ নৌকা ফুটো হয়ে ডুবে যায়। প্রবল বিক্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাঁরা জয়ী হয়েছিলেন, জয়ের আনন্দ উদ্‌যাপনের আগেই তাঁদের ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সলিলসমাধি হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দলনেতা মোশারফের দুই ভাই।

 এই ১১ জন হলেন দুই ভাই মনির, মোয়াজ্জেমসহ অন্যরা আমিন, মাহাবুবুর রহমান সুজা, খন্দকার রোজাউল মতিন রতন, আবদুল মতিন শিকদার আলম, শহিদুল্লাহ খোকন, আবুল হোসেন, শওকত আলী চৌধুরী কাঞ্চন, সৈয়দ শফিকুর রহমান বণিক ও মো. আলিম। অন্যরা সাঁতরে নদী পার হন। একদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে বিজয়ের মুহূর্তে সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনা তাঁদের শোকে মুহ্যমান করে তোলে।

এই দিনটির সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ওই দলের মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রতিবছর বিজয় দিবসে সহযোদ্ধাদের স্মরণ করেন তাঁরা। গতকাল মঙ্গলবার সহযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং আত্মার শান্তি কামনায় আজিমপুর কবরস্থানে এসেছিলেন তাঁদের সহযোদ্ধা ও স্বজনদের অনেকে।

সেদিনের সেই বেদনাদায়ক ঘটনার বিবরণ দিলেন ওই নৌকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধা অলি মিয়া (৭০)। লালবাগের ব্যবসায়ী অলি মিয়া বলছিলেন, ‘আমরা মোশারফ বাহানীর হয়ে যুদ্ধ করেছি। কুমিল্লা, সাভারে যুদ্ধ করে কেরানীগঞ্জে এসেছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর খবর পেলাম দেশ স্বাধীন হইছে। আমরা ঢাকার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুটি দলে ভাগ হলাম আমরা। এক নৌকায় মোশারফ ভাই আর তাঁর দুই ভাই মনির ও মোয়াজ্জেমসহ ২০-২২ জন ছিলাম। অপর নৌকায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা বন্দী ছিল। সঙ্গে ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। খোলামোড়া ঘাট থেকে মাঝনদীতে নৌকা আসতেই চিল্লাপাল্লা শুরু হয়ে যায়। আমাদের নৌকায় পানি ঢুকতেছে। নৌকা থেকে যে যেমনে পারলাম ঝাঁপ দিলাম। অনেক যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র, গায়ে গোলাবারুদ বাঁধা ছিল। পায়ে ছিল বুট। শরীর এমনিতেই ভারী ছিল। তাঁরা ঠিকমতো সাঁতার কাটতে না পেরে ডুবে গেল। আমরা কয়েকজন সাঁতরে বেঁচে গেলাম। সকাল হতে না হতেই দেখি আমাদের অনেকে নাই। বাড়ি থেকে জেলেদের ডেকে নদীতে জাল ফেলা হলো। একে একে পাওয়া গেল ১১ জনের লাশ।’

সহযোদ্ধাদের ডুবতে দেখা আরেক মুক্তিযোদ্ধ মো. হাতেম বলছিলেন, ‘১১ জনের লাশ তোলা হলে স্বজনেরা আসেন তাঁদের দেখতে। দাফন ও জানাজা শেষ নয়জনকে নিয়ে আসা হয় আজিমপুর নতুন কবরস্থানে। একে একে নয়জনকে শেষবারের মতো শুইয়ে দেওয়া হয়। আর শফিকুর রহমানকে বুয়েটে ও আলিমকে মৌচাক মোড়ে দাফন করা হয়। এ ঘটনার পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সহযোদ্ধাদের লাশের ছবি। তাই এই দিনে আমরা আজিমপুর কবরস্থানে মিলিত হয়ে তাঁদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই আর দোয়া করি।’

আজিমপুর কবরস্থানে গতকাল সকালে মনির হোসেন ও মোয়াজ্জেম হোসেনের বোন জাহানারা চৌধুরী তাঁর ভাইদের কবরের সামনে নীরবে চোখের পানি মুছছিলেন। তিনি ও তাঁর ভাই জানালেন, মোশারফ হোসেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রবাসী। আজিমপুরে পাশাপাশি দুই ভাইয়ের কবরও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার তিন ভাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ১৭ ডিসেম্বর সকালে দুজন মুক্তিযোদ্ধা মোটরসাইকেলে করে আমাদের বাড়ি আসেন। আর বাবা আবদুল আউয়াল (পুলিশের ডিআইজি ছিলেন) তাঁদের দেখে বলেন, তোমরা কেন এসেছ? আমার ছেলেরা ভালো আছে তো? মোটরসাইকেলের ওই দুজন বাবাকে কিছু না বলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সদর ঘাটে যান। পরে আমরাও যাই সেখানে। সেখানেই অন্যদের সঙ্গে ছিল মনির ও মোয়াজ্জেমের লাশ। আমার দুই ভাই একজন আরেকজনকে বাঁচাতে চেয়েছিল। তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিল। কোনোভাবে তাদের ছাড়ানো যাচ্ছিল না। আমৃত্যু যেন একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিল আমার দুই ভাই। তাদের মুখে কোনো বেদনার ছাপ ছিল না। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে দেশের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে তারাও শান্তির ঘুম দিয়েছে। বাবা ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিলাপ করে বলছিলেন, এত সুন্দর আমার ছেলেরা। আমি আগে তাদের ভালো করে দেখিনি...। এসব বিলাপ করতে করতে বাবা মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন।’ জাহানারা আর কথা বলতে পারলেন না, কেবল ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলেন।

 জাহানারার পাশেই ছেলের কবরের সামনে কাঁদছিলেন ওই দিন প্রাণ হারানো মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল্লাহ খোকনের মা সাফিয়া বেগম (৯৫)। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেন না। তবুও সন্তান হারানো এই মা ছেলের কবর ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন। ছেলের কথা জানতে চাইতেই তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। ক্ষিণ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘পোলা যোদ্ধা গেছে আমারে কয় নাই। ছয় মাস হারিকেন লইয়া বিছরাইছি (খুঁজেছি)। একদিন জানতে পারি যুদ্ধে গেছে। আর আসেনাই পোলা। যখন আইছে, তখন আর সে কথা কয় না।’ এ কথা বলে আবার কান্না শুরু করেন এই মা।

স্বজন হারানো মানুষ এখানে প্রতিবছর ১৭ ডিসেম্বর মিলিত হন। এদিন এই যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানান। কবরগুলোতে আলাদা নামফলক দেওয়া হয়েছে। বাঁধানো হয়েছে লাল–সবুজ টাইলস দিয়ে। একেকটি কবর যেন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের পতাকা।