রাজাকারের তালিকায় বঙ্গবীর কাদেরের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার নাম

মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদকারী হিসেবে আবদুল খালেক খসরুর সাহসের কথা বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে। বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে তাঁর নাম আছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ছিলেন খালেক। ১৯৭১ সালে শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবনবাজি রেখে অংশ নেন নানা গেরিলা অপারেশনে। স্বাধীনতার পর শেখ ফজজুল হক মণির নেতৃত্বে গঠিত যুবলীগের বগুড়া শাখার নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেন তিনি। ওই বছরের ১২ অক্টোবর তিনি মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদানের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে তাঁর নাম আছে।

মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় দেখা গেছে, রাজাকারের তালিকায় রাজশাহী বিভাগের ৫৪ নম্বরে আবদুল খালেক খসরুর নাম আছে। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালের ২৩ জুন বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা থাকার কথাও (মামলা নম্বর ২৩, স্থগিত) তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানা তালিকায় উল্লেখ নেই।

বগুড়ায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন অন্তত ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন, আবদুল খালেক খসরু নামে বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কোনো রাজাকারকে তাঁরা চেনেন না। এই নামে একজনকেই তাঁরা চেনেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক খসরু। সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তাঁকেই রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে বিতর্কিত করতে কেউ ইচ্ছে করে রাজাকারের তালিকায় তাঁর নাম দিয়েছেন বলে মনে করেন তাঁরা।

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগে খালেকের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বগুড়ার নাজ গার্ডেনের মালিক ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শোকরানা। তিনি বলেন, ‘বগুড়া শহরের মফিজ পাগলার মোড়ে খালেকের জন্ম। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কমান্ডো ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুবলীগ গঠিত হলে বগুড়া জেলা কমিটির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম আমরা দুজন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ করতে গিয়ে তিনি নিহত হন। তিনি আরও বলেন, রাজাকারের তালিকা প্রকাশ নিয়ে যা হচ্ছে এটা নিয়ে আদালতে রিট হওয়া দরকার।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বগুড়া সদর উপজেলা কমান্ডার আবদুল কাদের বলেন, বগুড়ার আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আবদুল খালেক খসরু। যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। সবাই তাঁকে একনামে চিনতেন।

বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক আরশাদ সায়ীদ রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ করাটা শুধু ধৃষ্টতা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মমর্যাদার প্রতি চরম অবমাননা। এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাজ হতে পারে না।’

মুঠোফোনে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল খালেক খসরুকে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই চিনতেন। তিনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর তিনি বগুড়া যুবলীগের নেতা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলাম। ওই বছরের ১২ অক্টোবর টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর পারে নিশ্চিন্তপুরে গুলিতে তিনি নিহত হন। যেখান থেকে তালিকা হয়েছে, সেখানে যোগ্য লোকের অভাব আছে।

খালেকের ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ খাজা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বড় ভাই একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নাম রাজাকারের তালিকায় থাকতে পারে না। তাঁর বিশ্বাস, নামের মিল থাকলেও যেহেতু পিতার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ নেই; সেহেতু অন্য কেউও হতে পারেন।