ভিপি নুরুল ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের পাল্টাপাল্টি মামলা

হামলার অভিযোগ এনে পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন৷ হামলার অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের পাঁচ নেতার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৩০-৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভিপি নুরুল আর ভিপি নুরুল ও তাঁর সংগঠনের আরও পাঁচ নেতার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ৷

আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন৷ দুটি মামলাতেই চাপাতি, রামদা, রড ও অস্ত্র দিয়ে হামলার অভিযোগ করা হয়েছে৷

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানাতে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ ডেকেছিলেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতা-কর্মীরা নুরুলের এ কর্মসূচিতে বাধা দেন। এতে সেখানে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়৷ ওই ঘটনায় নুরুলের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ১০ জন আর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ৫ জন আহত হয়েছেন বলে দুই পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়৷

এই ঘটনার প্রতিবাদে আজ দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ভিপি নুরুল বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নুরুলের সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা ও নুরুলকে ডাকসুর ভিপি পদ থেকে অপসারণের দাবিতে একই সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিল৷ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসেছিলেন৷ দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের ফলে উত্তেজনা তৈরি হয়৷ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়৷ একজন সহকারী প্রক্টর রাজু ভাস্কর্য এলাকা থেকে সবাইকে চলে যাওয়ার আহবান জানান এবং মঞ্চের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে থাকা লাঠিগুলো উদ্ধার করে নিয়ে যান প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা৷ কিছুক্ষণ পাল্টাপাল্টি স্লোগান শেষে ভিপি নুরুলের সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে চলে যান৷ তাঁরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন আর একই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ক্যাম্পাসে লাঠি মিছিল করে৷

টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও দোয়েল চত্বর হয়ে ফের রাজু ভাস্কর্যে এসে সমাবেশ করেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক৷ সেখানে নুরুল বলেন, 'স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে যারা ভণ্ডামি করে বেড়াচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকে যারা বিকৃত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, প্রতিবাদী মানুষের ওপর যারা হামলা-মামলা চালাচ্ছে, এদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এই গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতা দেখার জন্য ৩০ লাখ শহীদ জীবন দেননি৷'

পরে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করতে যান ভিপি নুরুল৷ নেতা-কর্মীরা থানার মূল ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন৷ একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা সেখানে গেলে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি স্লোগানে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়৷ তবে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের অনুরোধে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা সেখান থেকে চলে যান৷ পরে ভিপি নুরুলের সংগঠনে নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করতে শাহবাগে গিয়েছিলেন৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, হামলা করতে নয়, তাঁরা শাহবাগ থানায় নুরুলের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন৷ পুলিশ সদস্যরা তাঁদের নুরুলের পর মামলা দায়েরের অনুরোধ করলে তাঁরা ফিরে যান৷

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

ভিপি নুরুল ও তাঁর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে চলে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব৷ মঞ্চের একাংশের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন বলেছেন, আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আল মামুনের সঙ্গে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আর বুলবুল-মামুন নেতৃত্বাধীন মঞ্চ বলছে, অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন বর্তমানে মঞ্চের কেউ নন৷

অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন অভিযোগ করে বলেছেন, 'এনআরসির বিরুদ্ধে ভিপি নুরুলের ডাকা সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নাম ব্যবহার করে কতিপয় ব্যক্তি হামলা করেছে বলে একটি খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে এ ধরনের হামলার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন৷ মঞ্চের নাম ব্যবহার করে বুলবুল ও মামুনের নেতৃত্বে কিছু লোক সেখানে হামলা করেছে বলে শুনেছি৷ উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য বুলবুল ও মামুনকে গত ১০ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে৷ আমরা মনে করি, হামলার ঘটনাটি একটি সাজানো নাটক৷ বুলবুল-মামুনের সঙ্গে ভিপি নুরুলের আঁতাতের ভিত্তিতে এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে৷'

অন্যদিকে মঞ্চের অন্য অংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলছেন, অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেউ নন৷ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, 'জামাল স্যার একসময় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আহ্বায়ক ছিলেন৷ কিন্তু তাঁর অসুস্থ কর্মকাণ্ডে বিব্রত হয়ে মঞ্চের নেতা-কর্মীদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তাঁকে মঞ্চের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে৷ তিনি যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷'

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে একটি 'বিপজ্জনক ও ধূর্ত' সংগঠন বলল ছাত্র ইউনিয়ন

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে একটি 'বিপজ্জনক ও ধূর্ত' সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন৷ আজ বিকেলে সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ ও সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বৈষম্যমূলক 'সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল' পাশ হওয়ার প্রতিবাদে যখন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে গিয়েছিল এতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' এতই আক্রান্ত হয়েছে যে তারা শারীরিক আক্রমণ না করে নিজেদের নিরস্ত করতে পারেনি৷ অথচ বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান যখন আওয়ামী গুণ্ডাদের হামলার শিকার হন বা বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তীকে যখন স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হয়, তখন এই সংগঠন টু শব্দটিও করে না। এ যেন 'স্বাধীনতা' বলতে আদতে 'দাসত্ব' আর 'শান্তি' বলতে 'যুদ্ধ' বোঝায়!

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দপ্তর সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ভারতে এনআরসি ও ক্যাবের প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আহুত সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের হামলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। কারণ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকাই হল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একের পর এক হামলা গণমানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক ও ভুল অভিব্যক্তি তৈরি করছে৷