বধ্যভূমিটি চেনার উপায় নেই

ঝিনাইগাতীর কয়ারোড় বধ্যভূমি।  প্রথম আলো
ঝিনাইগাতীর কয়ারোড় বধ্যভূমি। প্রথম আলো

চারপাশে নীরবতা। কোলাহলমুক্ত গ্রামের বাঁশঝাড়ের নিচে শত শত শহীদের গণকবর। কাছে গিয়ে কেউ দেখিয়ে না দিলে জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি সম্পর্কে আঁচ করাই যাবে না। এই বধ্যভূমি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া কুনাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। স্বাধীনতাযুদ্ধে নির্যাতনের কালের সাক্ষী হয়ে অবহেলা–অযত্নে পড়ে আছে বধ্যভূমিটি।

নাম না-জানা শত শত শহীদের স্মরণে এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ না থাকায় বধ্যভূমিটি অযত্নে পড়ে আছে। এলাকাবাসী জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই এই বধ্যভূমির দেখা মিলবে। কোনো নামফলক নেই। ফলে এলাকাবাসী ছাড়া নতুন কেউ বুঝতেই পারবে না এই ঐতিহাসিক বধ্যভূমির অস্তিত্ব।

উপজেলার হাতীবান্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫০০ মিটার পশ্চিমে এই বধ্যভূমির অবস্থান। শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়কের কয়ারি রোড় এলাকা থেকে ৫০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরোলেই পবিত্র স্থানটি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী জেলার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করে কয়ারি রোড় এলাকায়। এখানে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। ক্যাম্পের পাশেই ছিল টর্চার সেল। যুদ্ধের সময় মানুষের আর্তচিৎকার এখান থেকে ভেসে আসত। ক্যাম্পের ৫০০ মিটার পশ্চিম পাশে ১০ শতাংশ জমিজুড়ে তিন ফুট গভীর গর্ত ছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী অসংখ্য মানুষকে ধরে এই ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করে মেরে ফেলত। পরে এই গর্তে মরদেহ ফেলে দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামবাসী এলাকায় ফিরে আসেন। তখন বড় গর্তটিতে অসংখ্য লাশ দেখতে পান তাঁরা। গ্রামবাসী মিলে গর্তে থাকা লাশগুলো মাটিচাপা দেন।

পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের শরণার্থীশিবির করা হয়। ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষ বাড়ি ফেরার পথে এই শিবিরে দুই-তিন দিন বিশ্রাম করতেন। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী ১২ শতাংশ এই বধ্যভূমির জমি অধিগ্রহণ করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।

গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, পাকিস্তানি ক্যাম্পের জায়গায় হাতীবান্দা ইউনিয়ন পরিষদ নির্মাণ করা হয়েছে। টর্চার সেলটিতে এখন ধানের চাতাল করা হয়েছে। ৫০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের দেখা মেলে। কোনো নামফলক নেই। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় ১০ শতাংশের স্তম্ভের বেদিতে খড় শুকানো হচ্ছে। অযত্নের ফলে স্মৃতিস্তম্ভে শেওলা পড়ে গেছে। অসংখ্য পরগাছা জন্মেছে।

ঘাগড়া কুনাপাড়া গ্রামের মো. মকবুল হোসেন জানান, ১০ শতাংশ জমিজুড়ে গভীর গর্ত ছিল। পাকিস্তানি হানাদারেরা টর্চার সেলে মানুষকে নির্যাতন করত।
তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যাঁরা মারা যেতেন, তাঁদের এই গর্তে ফেলে দিত। এখান থেকে কত আর্তনাদ, চিৎকার এলাকার মানুষ শুনতে পেতেন। এটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একই গ্রামের রফিক উদ্দিন জানান, পাকিস্তানি বাহিনী এখান থেকে চলে যাওয়ার পর এলাকার মানুষ গ্রামে ফিরে গর্ত ভর্তি লাশ দেখতে পান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাঝেমধ্যে শিয়াল, কুকুর এই গর্ত থেকে লাশ উঠিয়ে লোকালয়ে ফেলে যেত। পরে গ্রামবাসী তা গর্তে এনে মাটিচাপা দিতেন। ২০১৮ সালে বধ্যভূমির জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি।

হাতীবান্দা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমীন বলেন, এই বধ্যভূমির কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। এমনকি দেখাশোনার জন্য কোনো কমিটিও নেই। তিনি নিজ উদ্যোগে মাঝেমধ্যে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে থাকেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুবেল মাহমুদ বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন। এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বধ্যভূমির সীমানাপ্রাচীরসহ সারা বছর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া নতুন প্রজন্ম যেন এই বধ্যভূমির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে, সে জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।