জেঁকে বসেছে শীত, দুর্ভোগ

তীব্র শীতে জবুথবু জীবন। সবচেয়ে কষ্টে আছে শিশু ও বয়স্ক মানুষ। গতকাল দুপুরে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌর শহরের উত্তর বাজারে। ছবি: প্রথম আলো
তীব্র শীতে জবুথবু জীবন। সবচেয়ে কষ্টে আছে শিশু ও বয়স্ক মানুষ। গতকাল দুপুরে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌর শহরের উত্তর বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

সারা দেশে জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশা আর মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না।

প্রচণ্ড শীতে ঠান্ডাজনিত রোগ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষ ডায়রিয়া ও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ইতিমধ্যে এ ধরনের রোগী ভর্তি শুরু হয়ে গেছে অনেক হাসপাতালে।

নেত্রকোনায় গত বুধবার বিকেল থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সেখানে শীতের প্রকোপ অসহনীয় হয়ে উঠছে। গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় বেড়েছে। গ্রামের মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে।

গতকাল সকাল থেকেই ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের তেমন দেখা মেলেনি। কনকনে ঠান্ডায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শহরে লোকজনের চলাচল অনেক কমে গেছে।

কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী কচুগড়া গ্রামের মিল্টন মারাক বলেন, সপ্তাহখানেক ধরেই এখানকার মানুষ শীত অনুভব করছে। তবে বুধবার থেকে হঠাৎ শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর। অনেক পরিবার দরিদ্র হওয়ায় শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় পর্যন্ত কিনতে পারছে না। সরকারিভাবেও কোনো শীতবস্ত্র দেওয়া হচ্ছে না। তাদের শীতবস্ত্র খুবই প্রয়োজন।

হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর পুরানহাটি গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, হাড়কাঁপানো শীত। সবাই কষ্টে আছে। অনেকে খড় জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। এখন বোরো মৌসুম। শীত বেড়ে যাওয়ায় বীজতলা প্রস্তুত ও জমি চাষবাদ করতে বেগ পেতে হচ্ছে কৃষকদের।

শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ঠান্ডাজনিত রোগ বাড়ছে। কলমাকান্দা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবদুল আল মামুন জানান, ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম জানান, শীতার্ত দরিদ্র মানুষের জন্য ইতিমধ্যে জেলার ১০টি উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে ৪৩ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ৫০০ কম্বল দেওয়া হয়েছে। গত বছরের পুরোনো কিছু কম্বল ছিল, সেগুলোও বিতরণ করা হচ্ছে। আরও নতুন কম্বলের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

শেরপুর জেলা ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে। এ সময় দূরপাল্লার যানবাহন হেডলাইট জ্বালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলাচল করে। সদরের ব্রহ্মপুত্র নদে নৌচলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। দুপুর পর্যন্ত শহরের অনেক দোকান বন্ধ থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে।

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. খাইরুল কবির গতকাল সন্ধ্যায় জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যথাক্রমে ২৫ ও ১৪টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া বহির্বিভাগে অনেক শিশু চিকিৎসা নিয়েছে।

ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তী কাংশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, তাঁর ইউনিয়নে গরিব ও দুস্থ পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। অথচ সরকারিভাবে মাত্র ৩০০ কম্বল দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ এইচ এম আব্দুর রউফ বলেন, চলতি মৌসুমে সরকারিভাবে ২৫ হাজার ৬০০ কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ইতিমধ্যে জেলার পাঁচ উপজেলার চারটি পৌরসভাসহ ৫২টি ইউনিয়নে বিতরণ করা হয়েছে।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী। তাই সেখানে শীতের প্রকোপ একটু বেশি। মাঝেমধ্যে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। তিন দিন ধরে সূর্যের কোনো দেখা নেই। নারী-পুরুষ, শিশুসহ যানবাহনচালকেরা মাথায় টুপি, গায়ে গরম কাপড় ও চাদর পরে বের হচ্ছে।

নালিতাবাড়ীর কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, শীতে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন দিনমজুর শ্রমিকেরা। প্রচণ্ড ঠান্ডায় তাঁরা কাজে যেতে পারেননি। সীমান্তবর্তী পাহাড়সংলগ্ন পোড়াগাঁও, নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের মানুষ শীতের তীব্রতায় বেশি ভুগছে। শীত নিবারণে বাড়ি বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে সময় পার চলছে।

উপজেলা সদরের নির্মাণশ্রমিক সুলতানা বেগম বলেন, ‘শীতের লাইগা বাড়ি থাইকা বাইর ওয়াই কঠিন। এই শীতে কাম করমু কেমনে। শীতের লাইগা বেকার বইয়া রইছি।’

পৌর শহরের গৃহিণী আয়শা বেগম বলেন, ‘রোদের দেখা নাই। নিরুপায় অইয়া ছোট বাচ্চা লইয়া বাজারে আসছি।’

নয়াবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস আলী দেওয়ান জানান, তিন দিন ধরে এলাকায় প্রচণ্ড শীত। সীমান্তের মানুষ শীতে অসহায় হয়ে পড়েছে। গরম কাপড়েও শীত নিবারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি বাড়ি আগুন জ্বেলে অলস সময় পার করছে মানুষ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শরিফ ইকবাল জানান, কিছু এলাকায় বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ চলছে। তবে এই শীতে কোনো ক্ষতি হবে না।

ময়মনসিংহের নান্দাইলে বুধবার সকাল থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে। এদিন সকালে রোদ ছিল না। বিকেলে সূর্যের দেখা মিললেও রোদের উত্তাপ ছিল না। কুয়াশা ও প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজে যেতে পারছেন না।

নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. আকাইদ বলেন, হঠাৎ ঠান্ডায় বেশি কাতর হওয়ার আশঙ্কা শিশু ও বয়স্ক মানুষের। শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে গতকাল কয়েকজন বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে এসেছেন। এ ছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত কয়েকটি শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গতকাল সকালে নান্দাইলের একটি বেসরকারি সংস্থা দুস্থ শীতার্তদের কিছু কম্বল ও গরম কাপড় দিয়েছে। ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলা প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুস্থ শীতার্তদের জন্য এখনো সরকারি কম্বল আসেনি।

নান্দাইলের ইউএনও মুহাম্মদ আবদুর রহিম জানান, আগামী রোববার নাগাদ সরকারি কম্বল পাওয়া যেতে পারে। সেদিন কম্বল এলে পরদিনই ইউনিয়ন পরিষদে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।