ব্র্যাক আর স্যার আবেদ সমার্থক

স্যার ফজলে হাসান আবেদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
স্যার ফজলে হাসান আবেদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলের অর্থ বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় ত্রাণ দিতে গিয়েছিলেন দক্ষিণের দ্বীপ মনপুরায়। সে পদক্ষেপটিই হয়ে উঠল বৃহত্তর এক অভিযাত্রার প্রথম ধাপ। স্বাধীন দেশের ছিন্নমূল মানুষকে সহায়তা দিতে ব্র্যাক নামের যে বেসরকারি সংস্থাটি গড়ে তুলেছিলেন ৪৮ বছর আগে, সেটিই হয়ে উঠল বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা। আর যুক্তরাজ্য থেকে নাইট উপাধি পেয়ে তাঁর নামের আগে বসল ‘স্যার’।

বাংলাদেশের আজকের অগ্রযাত্রা ও সাফল্যে এখন স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম নিতে হয় সব ক্ষেত্রে, সব সময়। তিনি যে চিরকাল থাকবেন না, সে উপলব্ধি থেকে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে, ঠিক করে গেছেন উত্তরাধিকার। ব্র্যাকের সঙ্গে তাই স্যার ফজলে হাসান আবেদও বেঁচে থাকবেন এসব কাজের মধ্য দিয়ে।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা
স্যার ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে। বাবা সিদ্দিক হাসান ছিলেন ভূস্বামী। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। পূর্বপুরুষ ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশভাগের ঠিক আগে বাবা অসুস্থ হলে গ্রামের বাড়ি চলে এসে ভর্তি হন চাচার কর্মস্থলে, কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। পরে চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হলে তিনিও তাঁর সঙ্গে চলে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৌ স্থাপত্যে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে সেটা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর পেশাগত কোর্স সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে এসে ফজলে হাসান আবেদ যোগ দেন শেল অয়েল কোম্পানিতে। দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে হন ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়ই ১৯৭০ সালের বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেল্প’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে আত্মনিয়োগ করেন যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে এবং ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭১ সালে লন্ডনে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা
স্যার ফজলে হাসান আবেদ স্বাধীনতার পরপরই ভারত থেকে দেশে ফেরত আসা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে সুনামগঞ্জের শাল্লা এলাকায় ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। সে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির কথা। তখন এর নাম ছিল বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি। সংক্ষেপে ব্র্যাক। এখন ব্র্যাক আর স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। ব্র্যাকের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন।
ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে এখন ব্র্যাক কাজ করে। জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এনজিও অ্যাডভাইজার’ বিশ্বের শীর্ষে থাকা ৫০০টি এনজিও মূল্যায়ন করে বলেছে, প্রভাব, সৃজনশীলতা ও টেকসই হওয়ার বিচারে বিশ্বের সেরা এনজিও ব্র্যাক।
দারিদ্র্য বিমোচন কাজের বাইরে ব্র্যাক জরুরি ত্রাণসহায়তা, লিঙ্গসমতা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নগর উন্নয়ন, মানবাধিকার—এসব ক্ষেত্রে কাজ করে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্র্যাককে ঘিরে। এর মধ্যে আছে আড়ং, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক ফিশারিজ, ব্র্যাক নার্সারি, ব্র্যাক প্রিন্টিং, ব্র্যাক সিল্ক, ব্র্যাক লবণ, ব্র্যাক স্যানিটারি ন্যাপকিন অ্যান্ড ডেলিভারি কিট, ব্র্যাক সিড ইত্যাদি।

নেতৃত্ব পরিবর্তনের অনন্য দৃষ্টান্ত
স্যার আবেদ রেখে গেছেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের অনন্য এক দৃষ্টান্ত। গত আগস্ট মাসে তিনি স্বেচ্ছায় চেয়ারপারসনের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কেবল তা–ই নয়, নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে পরিবর্তনের পুরো কাজটি তিনি নিজে তত্ত্বাবধান করেন। এ নিয়ে প্রথম আলোকে চলতি বছরের ৩ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে আমি ব্র্যাকে আমার পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। ব্র্যাককে আমি ব্যক্তিনির্ভর না করে সব সময়ই সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছি।’ ব্র্যাককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কাজে যথাযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি ছিল তাঁর সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গর্ব এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্র্যাক এখন মোটাদাগে তিনটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলছে—ব্র্যাক গ্লোবাল, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাক। ব্র্যাক গ্লোবালের বোর্ডের চেয়ার জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরা হক। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ মুসা। আর ব্র্যাকের বোর্ডের চেয়ারপারসন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। ব্র্যাক এখন বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পেয়েছে ব্র্যাক।
২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন।
২০১৯ সালে শিক্ষার উন্নয়নে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ‘ইদান’ পুরস্কার পেয়েছেন।