চট্টগ্রাম নগরে বায়ুদূষণ: ছাড় পাচ্ছে সরকারি প্রকল্পগুলো

ধুলায় ধূসর নগর। গত শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায়।  জুয়েল শীল
ধুলায় ধূসর নগর। গত শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায়। জুয়েল শীল

বায়ুদূষণের দায়ে গত এক বছরে চট্টগ্রাম নগরের ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৩৮ লাখ ৯ হাজার ৬৬৬ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, সিএসএস করপোরেশন ও সালেহ স্টিলকে এক বছরে দুই দফা জরিমানা করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দূষণকারী সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বারবার ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।

বায়ুদূষণের জন্য নগরের ২৭টি স্টিল এবং সিমেন্ট কারখানাকে দায়ী করে আসছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে দূষণ অসহনীয় পর্যায়ে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রকল্পের উন্নয়নকাজকে চিহ্নিত করেছে দপ্তরটি। তবে সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা কম। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার নগরের চান্দগাঁওয়ের আরাকান সড়ক সংস্কারকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকে মাত্র এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

নগরের বাতাস মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে এবার। চট্টগ্রামের প্রতি ঘনমিটার বাতাসে গত মাসে বস্তুকণার পরিমাণ (পিএম১০) ছিল ৩০৯ মাইক্রোগ্রাম। গত তিন বছরে এটা সর্বোচ্চ। প্রতি ঘনমিটারে বাতাসে বস্তুকণার পরিমাণ (পিএম১০) অনধিক ১৫০ মাইক্রোগ্রাম থাকলে দূষণের সতর্কাবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে পরিবেশ যেমন অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে, তেমনি ধুলাবালুজনিত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।

বাতাসে বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি নির্দিষ্ট মানমাত্রার চেয়ে বেশি আছে উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগারের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বলেন, এসপিএমের (বড় ধূলিকণা) মানমাত্রা ২০০ এবং পিএম১০–এর মাত্রা ১৫০। কিন্তু দুটি উপাদান দ্বিগুণের বেশি আছে চট্টগ্রাম নগরের বাতাসে। সিডিএ, ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের চলমান প্রকল্পগুলোর কারণে দূষণ এমন অস্বাভাবিক হয়েছে।

চলছে ধুলার ঝড়
চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে সিডিএর দুটি, ওয়াসার তিনটি এবং সিটি করপোরেশনের কয়েকটি কাজ চলছে। আরাকান সড়ক, শাহ আমানত সংযোগ সড়ক, পিসি রোড, অ্যাকসেস সড়ক, আমবাগান সড়কসহ কয়েকটি পথে বড় ধরনের সংস্কারকাজ করছে সিটি করপোরেশন। 

এসব সংস্কারকাজের জন্য কোনো ছাড়পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নেওয়া হয়নি। 

আমবাগান সড়কে সরেজমিনে দেখা যায়, সংস্কারকাজের ফলে পুরো এলাকা ধুলায় সাদা হয়ে রয়েছে। চান্দগাঁও এলাকা এক বছরের বেশি সময় ধরে ধুলাবালুতে আচ্ছন্ন। একইভাবে নগরের পিসি সড়কে বড় বড় গর্তের পাশাপাশি উড়ছে ধুলাবালু। এই সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে আগ্রাবাদ অ্যাকসেস রোড। সেখানেও ধুলা।

সিডিএর অধীনে নগরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু তারা এখনো ছাড়পত্র নেয়নি। এ ছাড়া বাকলিয়া অ্যাকসেস সড়ক নির্মাণ, বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ডিটি রোড, রিংরোড নির্মাণের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সিডিএ। কিন্তু প্রথম দুটিতে এখনো কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।

এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, আগে ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় পরিবেশের এত বাধ্যবাধকতা ছিল না, তাই নেওয়া হয়নি। 

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মো. আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এবার ছাড় দেওয়া যাবে না। 

গলার কাঁটা ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি
সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ চলছে ওয়াসার। তাদের চারটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে নগরজুড়ে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার-২ এবং চিটাগং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্টের (সিডব্লিওএসআইএসপি) খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এ ছাড়া সুয়ারেজ প্রকল্পের একাংশের ডিপিপি অনুমোদন হয়েছে ইতিমধ্যে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ হয়েছে। প্রথম দুটি প্রকল্পের জন্য নগরজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘ওয়াসার চারটি প্রকল্প চলছে। প্রকল্পগুলোর দু–একটির পরিবেশ ছাড়পত্র আছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু দেখাতে পারেনি। না থাকলে নিতে বলেছি।’

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার কয়েকটি প্রকল্প চলছে। সিডব্লিওএসআইএসপির অধীনে পতেঙ্গা পর্যন্ত পাইপলাইনের একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়নি।

বাতাসের অবস্থা
প্রতি ঘনমিটার বাতাসে বস্তুকণার পরিমাণ ০-৫০ মাইক্রোগ্রাম ভালো, ৫১-১০০ মধ্যম, ১০১-১৫০ সতর্কাবস্থা, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরে বাতাসে গড়ে বস্তুকণার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৮ সালে ছিল ২৫৫ থেকে ২৬০ মাইক্রোগ্রাম। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গড়ে ধুলার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩০৯ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বব্যাপী বাতাসের অবস্থা পরিমাপকারী এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণে গতকাল রোববার ঢাকার অবস্থান ছিল চতুর্থ। তবে বিশ্বের দূষণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। নগরের আগ্রাবাদ, টিভি স্টেশন এবং নাসিরাবাদ এলাকায় তিনটি বাতাস পরিমাপের মেশিন রয়েছে। 

জরিমানা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে 
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, কারখানাগুলোকে জরিমানা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এখন প্রকল্পগুলোকে ধরতে হবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শামীম হাসান বলেন, ধুলাবালুর দূষণে শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসতন্ত্রের নানা প্রদাহে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।