পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে, উদ্বিগ্ন ৭৮ শতাংশ তরুণ

>বিশেষজ্ঞদের মতে, দূরত্ব বৃদ্ধির কারণে বঞ্চনা, মাদকে আসক্তি, অবসাদগ্রস্ততা, যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে।

মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে তরুণদের দূরত্ব বাড়ছে। দুর্বল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। তরুণদের একটা বড় সময় কাটছে সামাজিক মাধ্যমে বা ইন্টারনেটে। বর্তমান সময়ের তরুণেরা নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে।

প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত তারুণ্য জরিপ-২০১৯-এ তরুণেরা পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি নিয়ে তাঁদের এই মতামত দিয়েছেন। ১ হাজার ২০০ তরুণের মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। 

সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা অনেক দিন ধরেই পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে আসছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তরুণেরাও একই বিষয় নিয়ে চিন্তিত। তাঁরা মনে করছেন, মা–বাবার সঙ্গে সন্তানের মানসিক যোগাযোগ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী, ৭৮ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ মনে করেন, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বাড়ছে। মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী হলে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। এ কারণেও দূরত্ব বাড়ছে বলে তরুণদের অনেকে মনে করেন। 

 তবে মা–বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বাড়ছে—তরুণদের মধ্যে এই ধারণা দুই বছর আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। ২০১৭ সালে প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ বলেছিলেন, মা–বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বাড়ছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সন্তানেরা এখন নিজেদের সমস্যার কথা মা–বাবাকে আগের চেয়ে সহজে খুলে বলতে পারে, তবে এটি সব ক্ষেত্রে নয়। একান্ত ব্যক্তিপর্যায়ের আলোচনাগুলো সন্তানেরা এখনো বাইরে বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে। সন্তানের আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের নিজস্ব পরিমণ্ডলে অভিভাবকদের অংশ নিতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের একটি মানসিক যোগাযোগ থাকতে হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তরুণদের সঙ্গে অভিভাবকদের দূরত্ব বাড়ছে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার দিক থেকে দুই পক্ষেরই ঘাটতি রয়েছে। তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে খুব বেশি সামাজিক হতে গিয়ে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে অনেকে।

জরিপে তরুণদের কাছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের তিনটি প্রধান বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, অভিভাবক ও পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো নিয়েই তরুণেরা বেশি উদ্বিগ্ন। এরপর রয়েছে জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ। 

জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ তরুণই মনে করেন, পারিবারিক বন্ধন দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। আবার এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমতও আছে। দ্বিমত পোষণ করেছেন ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। দ্বিমত পোষণকারী তরুণেরা বলছেন, চাকরি বা শিক্ষার জন্য তরুণদের অনেক সময় পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। এ কারণে অনেকে ধারণা করেন, তরুণেরা পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আদতে তা ঠিক নয়।

এবারের জরিপে বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী হলে সন্তান অভিভাবকের কাছ থেকে সময় ও মনোযোগ কম পায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা নিজেরাও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া শৃঙ্খলা ও পড়ালেখা নিয়ে অত্যধিক চাপ দেওয়ায় এবং সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারার কারণেও অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বাড়ছে। এর ফলে বঞ্চনা, মাদকে আসক্তি, অবসাদগ্রস্ততা, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, সন্তানের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার, আচরণে পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর প্রতি অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানকে সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৭২ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ বলেছেন, পরিবারের সঙ্গে একত্রে থাকা নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। দুই বছর আগেও তরুণদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে থাকা নিয়ে প্রায় একই রকম উদ্বেগ ছিল। ২০১৭ সালের জরিপে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ এ বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। 

তরুণদের অবসর কাটছে ইন্টারনেটে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান (চ্যাটিং) করে। জরিপে দেখা গেছে, ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণের অবসর কাটে ইন্টারনেটে। অবসরে ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকার প্রবণতা উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেশি, প্রায় ৭০ শতাংশ।

তরুণদের খেলাধুলা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকাকে সামাজিক মাধ্যমের দিকে ঝোঁকার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমকে দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু তরুণেরা এটিকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার না করে সময়ের অপচয় করেন। এগুলোর অতিমাত্রায় ব্যবহার তরুণদের শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করে, শৃঙ্খলা ও মনোযোগ নষ্ট করে এবং অসামাজিক করে তোলে।

তবে তরুণদের একটা অংশ বলেছেন, তাঁরা ইন্টারনেটে শুধু কেবল সময় অপচয় করেন না, তাঁরা ইন্টারনেটে উৎপাদনশীল কাজও করেন। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কাজে, চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি খুঁজে পেতে এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হালনাগাদ তথ্য পেতেও ইন্টারনেট সাহায্য করে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানের হাতে মুঠোফোন দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের মানসিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের সঙ্গে বন্ধন জোরালো হলে তরুণদের মধ্যে অন্যান্য বিষয় নিয়ে উদ্বেগ কমবে।

সংশোধনী
গতকাল তারুণ্য জরিপের প্রথম পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রকৃতপক্ষে প্রতি চারজনের তিনজন বললে যথার্থ হতো। বা.স.