শীত আসতেই নদী-বিলে অবাধে চলছে পাখি শিকার

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বিলে বিষ মিশিয়ে পুঁটি মাছ ছেড়েছিলেন এক ব্যক্তি। উদ্দেশ্য পাখি শিকার। কিন্তু পাখির সঙ্গে বিষমাখা সে মাছ খেয়েছে এক খামারির ডিমপাড়া হাঁস। এতে ৩৬টি হাঁস মারা গেছে। অসুস্থ হয়েছে আরও ১০০টি। গত শনিবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটে চলনবিল বিস্তৃত পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কানাগারা বিলে।

শীতের শুরু থেকে এভাবে পাবনার নদী ও বিল এলাকায় শৌখিন ও পেশাদার শিকারিরা অবাধে পাখি শিকার করেছেন। এসব পাখি শহর ও গ্রামের হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।

২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ পুনরায় করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা, দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন থাকা সত্ত্বেও পাবনায় অবাধে পাখি শিকার করা হচ্ছে।

ডিসেম্বরের প্রথম দিন জেলা সদরের কোমরপুর গ্রামে পদ্মার চরে বেড়াতে গিয়েছিলেন পাবনার কয়েকজন তরুণ। তাঁদের একজন বলেন, তাঁদের চোখে পড়েন এক শিকারি। জাল ফেলে তিনি বাবু বাটান, নথ জিরিয়া, বালু জিরিয়া পাখি ধরছিলেন। বিক্রির জন্য আটকে রাখছিলেন খাঁচায়। পরে তরুণেরা পাখিগুলোকে উদ্ধার করে মুক্ত করেন।

জেলার বিল ও নদী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় নদী ও বিলের পানি কমে গেছে। জেগে উঠছে ফসলের মাঠ। যেসব স্থানে অল্প পানি জমে আছে, সেখানে মাছের আনাগোনা রয়েছে। ফলে মাছ খেতে মাঠে নামছে বক, ডাহুক, ঘুঘু, পানকৌড়ি, বালিহাঁসসহ বিভিন্ন জাতের পাখি। আসছে পরিযায়ী পাখির দল। আর এ সুযোগেই শিকারিরা অবাধে পাখি শিকার শুরু করেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার চলনবিল, সাঁথিয়া উপজেলার ঘুঘুদহ ও সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল থেকে ধরা হচ্ছে বক, বালিহাঁস, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন জাতের পাখি। জেলা সদর, বেড়া উপজেলার ঢালারচর ও ঈশ্বরদী উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পাড় থেকে ধরা হচ্ছে সারস, বালিহাঁসসহ বিভিন্ন জাতের পাখি। বিষটোপ, জাল, বড়শি ও এয়ারগান দিয়ে শিকারিরা এসব পাখি শিকার করছেন। পরে তা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ও গোপনে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

>

পেশাদার শিকারিরা এসব পাখি শহর ও গ্রামের হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গোপনে বিক্রি করছেন। তবে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।

রবিউল ইসলাম নামে চলনবিলের এক পাখি শিকারি বলেন, ‘আমরা পেটের দায়ে পাখি মারে বেচি। মেলা শিক্ষিত মানুষ তো হুদেই বন্দুক দিয়ে পাখি মারে। তা তো কেউ দেহে না।’

তিনজন পাখিবিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাখি কেনার জন্য নির্ধারিত ক্রেতা আছেন। উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশার মানুষ এই পাখি কেনেন। মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাখি পৌঁছে দেওয়া হয়। বর্তমানে পাখির চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশ চড়া।

বিক্রেতারা বলেন, প্রতি জোড়া সাদা বক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কালো বক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, ঘুঘু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, চখা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, বালিহাঁস ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও বড় সারস ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জেলার বন্য প্রাণী–বিষয়ক সংগঠন নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন কমিউনিটির সভাপতি এহসান আলী বিশ্বাস বলেন, তাঁরা পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি তুলে বেড়ান। প্রতিদিন ছবি তুলতে গিয়ে দেখছেন পাখি শিকার করা হচ্ছে। কেউ পেশাদার, কেউ শৌখিন শিকারি। পাখি নিধন বন্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে দেশ থেকে পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহী কার্যালয়ের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, রাজশাহী থেকে পুরো বিভাগ দেখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে গত সপ্তাহে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বন বিভাগকে পাখি নিধন বন্ধে চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সচেতনতা ও নজরদারি বাড়ানো হলে পাখি নিধন কমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।