প্রতিবন্ধীদের কর্মক্ষম করতে হবে

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। পাশে সিডিডি’র নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে।  প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। পাশে সিডিডি’র নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে। প্রথম আলো

বিশ্বজুড়েই প্রতিবন্ধী মানুষদের কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা গেলে একদিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে, অন্যদিকে প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনমানেরও সামগ্রিক উন্নয়ন হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বিদ্যমান আইন ও মূলধারার উন্নয়ন কার্যক্রম: প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি সম্পৃক্তকরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলোর আয়োজনে এই গোলটেবিলে যৌথভাবে সহযোগিতা করেছে সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিবিএম।

বৈঠকে আলোচকেরা আরও বলেন, দেশের প্রতিবন্ধী তালিকায় রয়েছে ১৬ লক্ষাধিক মানুষ। তাদের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি নানা কার্যক্রমও চলছে। অধিকার নিশ্চিত করতে রয়েছে আইন। এরপরও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। কার্যক্রমগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ঘাটতিই এর মূল কারণ। সমাধানে দরকার জবাবদিহির সংস্কৃতি ও নজরদারি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে আইনগত জটিলতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। তিনি বলেন, প্রচলিত আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেই কেবল তাদের অভিভাবকত্ব দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রতিবন্ধীরা নিজের সম্পত্তির দেখভাল, আর্থিক লেনদেনসহ তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে না। এর সংশোধন দরকার।

সিডিডির নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান বলেন, এখন প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে অনেক তথ্য রয়েছে। অনেক বিষয়ে অগ্রগতিও এসেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাচ্ছে না। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গৃহীত উদ্যোগ বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজের বিষয়ে নিজেদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শেখ হামীম হাসান। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রবেশগম্যতা, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানের বিষয় সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু তাদের এ–সংক্রান্ত সেবা নিশ্চিত করতে দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নেওয়া পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে সুরক্ষা আইনের অনেকটাই বাস্তবায়িত হবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সূচনা বক্তব্য শেষে সিডিডির পরিচালক নাজমুল বারী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা দরকার। কার্যকরী পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা-বয়স-লিঙ্গসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে কর্মসূচিতে তাদের প্রয়োজন বিবেচনা করা দরকার বলেও জানান তিনি।

তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে নেওয়া সব পরিকল্পনার মূল্যায়ন করা দরকার বলে জানান সিবিএম কান্ট্রি কো–অর্ডিনেশন অফিসের অ্যাকটিং কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যের ওপর নির্ভরশীল বলে তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দের সময় তত্ত্বাবধানকারীদের কথাও বিবেচনা করতে হবে। সর্বোপরি পর্যবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। 

সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জুহুরুল আলম বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মহীনতা দেশের জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ জন্য তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় কর্মপরিবেশের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখাতে হবে।

কোথাও প্রতিবন্ধী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করলেই একীভূতকরণ হয়ে যায় না বলে মন্তব্য করেন হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাবেয়া সুলতানা। জন্মগত প্রতিবন্ধিতা ছাড়াও বয়সজনিত প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। কিন্তু তাদের কথা বিবেচনা করে দেশে তেমন কোনো পরিকল্পনা করা হয় না, অথচ তা ভীষণ জরুরি।

সাইটসেভার্স বাংলাদেশ কান্ট্রি অফিসের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সৈয়দা আসমা রাশিদা বলেন, সাধারণ হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবন্ধীরা সেবা পায় না। আবার প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রেও সেবা পেতে নানান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

যেকোনো আলোচনায় প্রতিবন্ধী মানুষকে সম্পৃক্ত করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন লিওনার্ডো চেসারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম রিপ্রেজেনটেটিভ জহির-বিন-সিদ্দিক। তিনি বলেন, দেশে এখন অবকাঠামোগত অনেক কাজ হচ্ছে। সেখানে প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনা করে র‌্যাম্প, দরজার ছিটকিনির অবস্থানসহ নানা ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাভারের সিআরপির নির্বাহী পরিচালক মো. শফিক উল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধী একটি শিশুকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। তাই প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। সেটা শুরু করতে হবে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে।

প্রতিবন্ধীসেবা যাতে তৃণমূল পর্যায়ে পাওয়া যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. শফিকুল ইসলাম। 

সুইড বাংলাদেশের এনআইআইডিএ কমিটির সদস্য তাজকেরা খানম বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক প্রতিবন্ধী শিশু তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।