মজুরিবিহীন কাজে নারীর 'দাপট'

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

গৃহে নারীর কাজের বাজারমূল্য নেই। তাই একে জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) অন্তর্ভুক্তও করা হয় না। গৃহের কাজে পুরুষের চেয়ে সাড়ে ৪ গুণের বেশি অবদান রেখেও নারীদের শুনতে হয়, তিনি ‘কিছু করেন না’। সরাসরি শ্রমবাজারে না থাকা এই নারীরা সারা জীবন এই উপাধি নিয়েই গৃহস্থালির কাজ সামলিয়ে জীবন পার করেন। মজুরিবিহীন এই কাজে নারী একচেটিয়া ‘দাপট’ দেখিয়ে চলেছেন। গবেষকদের ভাষায়, গৃহে নারীর কাজের আনুমানিক বার্ষিক মূল্য জিডিপির ৭৭ শতাংশের সমপরিমাণ।

তবে গৃহে নারীর কাজকে মূল্যায়ন করার জন্য চারদিকে আলোচনা হচ্ছে। জিডিপিতে না হলেও স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট অর্থাৎ কাজের ছায়া মূল্যের প্রতিস্থাপন পদ্ধতি এবং জেন্ডার সহায়ক বাজেটের গুরুত্বের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট বা ছায়া মূল্য দিয়ে নারীর মজুরিবিহীন কাজের হিসাব বের করা সম্ভব।

নারীর মজুরিবিহীন গৃহস্থালির কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার বা কাজের অবদানের মূল্যায়নের আলোচনা দীর্ঘদিনের। মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলে আসছেন অনেকে। কাজের ছায়া মূল্য ব্যবহার করে সিপিডি প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে দেখিয়েছে, জাতীয় আয় হিসাবে (জিডিপি) অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজ যা নারীরা করছেন, তার আনুমানিক বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থবছর) জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমপরিমাণ।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) নারীর মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি ও জেন্ডার বাজেটে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে সানেম শ্রম শক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর তথ্য ধরে দেখিয়েছে, জিডিপিতে গৃহে মজুরিবিহীন কাজের অবদান ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তাতে নারীর অবদান ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষের অবদান ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

সানেমের অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক জুবায়ের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গৃহে নারীর মজুরিবিহীন কাজের স্বীকৃতি দরকার। কাজের ছায়া মূল্যের প্রতিস্থাপন পদ্ধতি দিয়ে মূল্যায়ন করেছি। আমরা একটা প্রক্সি প্রাইস ধরে জিডিপি অনুপাতে আর্থিক মূল্য বের করেছি।’

তিনি জানান, সানেমের গবেষণায় প্রক্সি প্রাইস বের করা হয়েছে শ্রমিকের দৈনিক মজুরির হিসাবে। দুভাবে এর মূল্য ধরা হয়েছে। একটা হচ্ছে, যেসব নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যুক্ত তাঁদের বেতনের দৈনিক মজুরির গড় হিসাব থেকে। অপরটি হচ্ছে দৈনিক শ্রমের ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মজুরি থেকে। এখানে বয়সও বিবেচনা করা হয়েছে। এ দুটোর যোগফল থেকে নারীদের গৃহের মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের হিসাব বের করা যায়।

জুবায়ের হোসেন জানান, নারীর গৃহের কাজের মূল্যায়ন করতে হলে হালনাগাদ তথ্য লাগবে। এর জন্য যে ধরনের তথ্য বা জরিপ দরকার হয়, তা যদি নিয়মিত করা হয়, তবে স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট বা ছায়া মূল্য দিয়ে নারীর মজুরিবিহীন কাজের হিসাব বের করা সম্ভব। প্রতি দু-তিন বছরে তথ্যগুলো হালনাগাদ করা হলে সরকার তা ধরে একটা হিসাব বের করতে পারে। এখানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে ভূমিকা রাখতে হবে। তাতে নারীর অবদান কত, তা বের হয়ে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো ও জি-৭-এর দেশগুলো টাইম ইউজ ডেটা দিয়ে প্রতিস্থাপন পদ্ধতির মাধ্যমে এ হিসাব বের করে।

সানেম জানিয়েছে, নারীদের মজুরিবিহীন কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হলে এসব কাজকে সহজ করতে বিভিন্ন বিনিয়োগ শুরু হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হবে। সেবামূলক কাজকে শ্রমবাজারে নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক প্রথম আলোকে বলেন, নারীর মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি জেন্ডার বাজেটে সহায়ক কিছু নীতিও গ্রহণ করতে হবে। জেন্ডার বাজেটের অধীনে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প থাকে। অনেক নারী এই সুবিধা নিতে অসমর্থ হবেন, যদি তাঁদের গৃহস্থালি কাজের ভার কমানোর জন্য কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে সহায়ক কোনো সুবিধা না থাকে। এই সুবিধা না থাকলে নারী ওই প্রকল্পের সুবিধাভোগী হতে পারেন না এবং প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা হারিয়ে যায়।

নারীর কাজের গুরুত্ব তুলে ধরার ওপর জোর দিয়ে অধ্যাপক সায়মা হক আরও জানান, নারীর শ্রমবাজারের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় গৃহস্থালির কাজ। জেন্ডার বাজেটকে কার্যকর করতে হলে এর সঙ্গে সহায়ক নীতিও তৈরি করতে হবে। যেমন: প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে হলে সেখানে একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে যানবাহনের ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, ‘নারীর এই কাজকে প্রথমে স্বীকৃতি দিতে হবে। কেউ কিন্তু বলছে না নারীর এই কাজের পারিশ্রমিক দিতে হবে। কিন্তু এর একটা মূল্য বের করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে এর গুরুত্ব কতটা। আর স্বীকৃতির সঙ্গেই আসবে কাজের ভার হ্রাস করা এবং কাজের পুনর্বণ্টনের বিষয়।’