বাড়ছে আমের বাগান, কাজ হারাচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ

‘গত ১৫ বছরে চাষাবাদের ক্ষেত্রে পাল্টে গেছে আমাদের এলাকা। আগে চারদিকে শুধু ধান, সরিষা বা গমের খেত দেখা যেত। ধীরে ধীরে কৃষিজমিগুলো সব আমবাগান হয়ে যাচ্ছে। আম চাষে ধান বা অন্য ফসলের মতো তেমন পরিচর্যা লাগে না। তাই মজুরের (শ্রমিক) তেমন প্রয়োজন হয় না। লাভ হওয়ায় আমাদের এলাকায় ক্রমেই বাড়ছে আম চাষের পরিধি।’ 

কথাগুলো বলছিলেন নওগাঁর পোরশা উপজেলার নিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ্ মো. আবুল কালাম চৌধুরী। ইদানীং নওগাঁয় আম চাষ বাড়ার বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। ‘আম চাষে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে নওগাঁ’, ‘নওগাঁয় শত কোটি টাকার আমের বাণিজ্য’, ‘নওগাঁয় আম চাষে লাভবান হচ্ছে মানুষ’ এ জাতীয় শিরোনামে ইতিবাচক খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হয়েছে। নওগাঁয় চিরাচরিত কৃষিচিত্র পাল্টে যাওয়ায় মানুষের জীবন-জীবিকায় কী পরিবর্তন এসেছে-তার উত্তর খুঁজতে সম্প্রতি জেলার ঠা ঠা বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত পোরশা ও সাপাহার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালান এই প্রতিবেদক। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলায় আমবাগান গড়ে উঠেছে ১৯ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পোরশাতে আমবাগান রয়েছে ৯ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। সাপাহারে বাগান রয়েছে ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। জেলায় প্রতিবছর দেড় হাজার হেক্টর জমিতে নতুন করে আমবাগান গড়ে উঠছে। 

পোরশা ও সাপাহার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা দুটির অধিকাংশ জমিই এক ফসলি। এখানকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে। স্থানভেদে যা ৮০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত গভীরে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে এখানে চাষাবাদের সুযোগ নেই। বছরে মাত্র একবার আমন ধান উৎপন্ন হয়ে থাকে, যা বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে এখানকার কৃষকেরা অনেক সময় আমনও চাষ করতে পারেন না। তার ওপর গত কয়েক বছর ধরে ধান আবাদ করে লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। আর কিছু জমিতে গম, সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়ে থাকে। 

তবে এসব ফসলের চেয়ে আম উৎপাদনে পানি ও শ্রমের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আম বাগানে সাধারণত প্রথম বছর গাছের পরিচর্যা করতে হয়। এরপর পরে আর পরিচর্যা খুব একটা করতে হয় না। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে আম চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন আম চাষিরা। ধীরে ধীরে এ দুই উপজেলার বিপুল পরিমাণ জমি আম বাগানে পরিণত হচ্ছে। আর এ পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষ লাভবান হলেও বিপাকে পড়ছেন দিনমজুরেরা। ফসলের আবাদ কমে যাওয়ায় কাজ হারাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে কৃষি শ্রমনির্ভর এ এলাকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। কৃষিতে শ্রমের কাজ না থাকায় এবং অন্য পেশায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারায় তাঁরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। 

পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সহড়ন্দ গ্রামের বাড়ির উঠানে অলস সময় পার করছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কয়েকজন নারী। কী করছেন জানতে চাইলে মাঝবয়সী এক নারী বলেন, ‘কী করমু ভাই, হ্যামগের কাম-কাজ নাই। তাই বসি বসি গপ্প-গুজব করোছু। কুনটি (কোথায়) ধান? মাঠোত চ্যায়া দ্যাখেন তো ধান আছে নাকি? য্যাকনা ধান আবাদ হছিল, এক সপ্তার (সপ্তাহ) মধ্যেই কাটা হই গিছি।’ তিনি বলে চললেন, ‘হামাগের তো নিজের জমিজমা নাই। অন্যের জমিত মজুর বিক্রি করে হামরা চলি। জমির মালিকেরা খ্যাত-খামার বাদ দিয়ে আম বাগান করে ফ্যালায় মজুরি দিয়ে কাম করার দিন ফুরায় গেছি।’ 

পোরশার আমনারায়নপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাড়ার অরুণ কুমার, কার্তিক, সুবল, রাজিবসহ ১০-১২ জন কৃষি শ্রমিক জানান, বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের নিজস্ব জমি নেই। অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে তাঁরা জীবন নির্বাহ করে থাকেন। আবাদি জমিতে আমের বাগান হয়ে যাওয়ায় তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এলাকায় যেটুকু কৃষিকাজ রয়েছে, কৃষি শ্রমিকের জোগান বেশি হওয়ার সুযোগে জমির মালিকেরা তাঁদের কম মজুরি দিচ্ছেন। ফলে দিন দিন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষেরা আরও দুর্দশার মধ্যে পড়ছে। 

সাপাহার উপজেলার কুড়লডাঙ্গা গ্রামের মঙ্গল কুমার বলেন, ‘হামাগের জ্যাতের (জাতি) পুরুষ মানুষেরা তাও ভ্যান-ভটভটি চালায়ে কিছু আয় করতে পারোছি। কিন্তু হামাগের ম্যায়া মানুষেরা তো এখন ভাত আঁন্ধা আর সংসার দেখা ছাড়া আর কুনুহ কাজিই নাই। আগেও ওরাও হামাগের পুরুষের সমান উপার্জন করত। কিন্তু এখন চারদিকে বাগান হয়ে যাওয়ায় মাঠোত আর কোনো কাজ নাই। এ জন্য ওরা প্রায় সারা বছর বেকার বসে থাকে।’ 

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবিন চন্দ্র মুন্ডা জানান, নওগাঁর ১১টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের বাস। ১১টি উপজেলার মধ্যে পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা, মহাদেবপুর ও নিয়ামতপুর উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের বসবাস সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, আদিবাসীদের ‘ভূমিজ সন্তান’ বলা হয়। নিজস্ব জমিজমা না থাকায় প্রায় ৯৫ ভাগ জনগোষ্ঠীই দিনমজুর হিসেবে কাজ করে থাকে। কলকারখানা না থাকায় এ অঞ্চলে কৃষিনির্ভর কাজই বেশি। আবাদি জমি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে কৃষিকাজ। এর ফলে বিপাকে পড়ছেন কৃষিশ্রমিকেরা। বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী যাঁরা কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কাজ জানেন না, এর ফলে তাঁদের জীবনমান দিন দিন কমছে। 

এ বিষয়ে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন বরেন্দ্রভূমি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার (বিএসডিও) নির্বাহী পরিচালক আবদুর রউফ জানান, ধান চাষের পরিবর্তে আম উৎপাদনে শ্রমিক কম লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কৃষির ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর্মহীন সময়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু, আম বাগান ও আম ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্বল্প সুদে ঋণের মাধ্যমে তাদের বিকল্প আয়ে নিয়োজিত করা যেতে পারে।