আতঙ্কে ঘুম হারাম বায়েজিদ বোস্তামীর দেড় লাখ মানুষের

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করে সংষর্ঘ ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। এতে আতঙ্কে রয়েছে এখানকার দেড় লাখ মানুষ। এমনকি অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে গত বছরের জুনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িও ভাঙচুর করেছে দখলকারীরা। আধিপত্য বিস্তারের জেরে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে ক্ষমতাসীন দলের দুই পক্ষের মধে৵ হাতাহাতির পর ছুরিকাঘাতে একজন নিহত হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তারের জেরে গত পাঁচ বছরে এখানে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটে।

যুবলীগ নামধারী এ এম মহিউদ্দিন ও মো. দিদার এবং স্থানীয় ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবুর অনুসারীদের মধে৵ দীর্ঘদিন থেকে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সাহেদ ইকবাল ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। মঙ্গলবার নিহত হওয়া মো. রিপন বায়েজিদ বোস্তামী বাংলাবাজার হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কাউন্সিলরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ভাই বাদী হয়ে মহিউদ্দিন, দিদারসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা করেছেন।

দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর গা ঢাকা দেন মহিউদ্দিন-দিদার। গত মাসের মাঝামাঝি তাঁরা আবার এলাকায় ফিরে আসেন। কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে র‍্যাব-পুলিশের তালিকায়ও তাঁদের নাম রয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বায়েজিদ থানাধীন নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চলে দুই শতাধিক কারখানায় চাঁদাবাজি, বিতর্কিত ও পাহাড়ি খাসজমির দখল-বেদখল ঘিরে সক্রিয় রয়েছে যুবলীগ নামধারীরা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শফিকুল ইসলাম, মো. আবদুল কুদ্দুছ ও মেহেদী হাসান ওরফে বাদল নামে যুবলীগের তিন নেতা পৃথক তিনটি বাহিনী গড়ে তোলেন। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাতে যুবলীগের নেতা মেহেদী হাসানকে নিজ বাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নিহত হওয়ার পর ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন মহিউদ্দিন ও দিদার। শফিকুল বিদেশে চলে যান। মেহেদী হত্যার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন কুদ্দুস।

নিহত মেহেদীর স্ত্রী মোবাশ্বেরা বেগম বলেন, তাঁর স্বামীকে খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রকাশে৵ ঘুরলেও পুলিশ ধরছে না।

গত বছরের ১৩ মে দুপুরে বায়েজিদের বাংলাবাজার এলাকায় সড়ক দখলমুক্ত ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিয়া আক্তারের জিপসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় আহত হন বায়েজিদ বোস্তামী থানার এএসআই মুজিবুর রহমান, নায়েক নাছির, কনস্টেবল কায়েস ও রাজ্জাক। পরদিন অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হামলাকারী মো. জসিম ওরফে পানি জসিম আহত হন। তিনি দিদার-মহিউদ্দিনসহ একটি গ্রুপের সঙ্গে জমি দখল ও চাঁদাবাজিতে যুক্ত ছিলেন। একসময় ছাত্রদল করলেও গত কয়েক বছর ধরে তিনি নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।

গতকাল বুধবার দুপুরে বাংলাবাজার, শেরশাহ এলাকার অন্তত ২০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা অভিযোগ করেন, দিদার ও মহিউদ্দিনের অনুসারীদের চাঁদাবাজি, জায়গা দখল চললেও ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে সম্প্রতি বাংলাবাজার এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এলাকায় যারা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস করে তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। স্থানীয় লোকজন জানান, দুজনের অনুসারী মো. এমদাদ, মিল্টন বড়ুয়া, মহিন উদ্দিন, ফয়সাল ওরফে ডিবি ফয়সাল, বিহারী ফজল, আশিকুর রহমান, নুর হোসেন, মাছ রফিক, সিরাজ, আনোয়ার, সানি, ফজলে রাব্বি, মো. মোমিন, শওকত উল্লাহ, মো. পারভেজ, শিপন, রায়হানসহ শতাধিক তরুণ রয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল ওরফে বাবু প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে দিদার ও মহিউদ্দিন জমি দখল, চাঁদাবাজি করে আসছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একাধিকবার জানানো হয়েছে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর দিদার ও মহিউদ্দিন গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানান বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজার বসিয়ে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ বন্ধ করা হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল মহিউদ্দিন ও দিদারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দিদারুল আলম বলেন, মহিউদ্দিন ও দিদার নামে নগর যুবলীগে কেউ নেই। দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে যেন প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়।

যে কারণে খুন রিপন

বায়েজিদ বোস্তামীর বাংলাবাজার এলাকায় অবৈধ দুই শ দোকান বসিয়ে দোকানপ্রতি দিনে দুই শ টাকা করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে দিদার-মহিউদ্দিনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। গত জুন মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত এগুলো তুলে দেয়। সম্প্রতি দোকানগুলো আবার বসানোর চেষ্টা করে তারা। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান বাংলাবাজার হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন। বিষয়টি নিয়ে দুই মাস আগে তাঁকে হুমকি দেওয়া হলে আদালতে মামলাও করেন রিপন।

বাংলাবাজার হকার্স লীগের সহসভাপতি জান্নাত বেগম বলেন, বাংলাবাজার এলাকায় অবৈধ দোকান বসানো ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় রিপনকে হত্যা করা হয়েছে।

রিপনের বড় ভাই ও মামলার বাদী মো. আজাদ বলেন, ‘ভাইকে ফিরে পাব না। হত্যাকারীদের বিচার যেন হয়।’

ওসি প্রিটন সরকার জানান, ঘটনার পরপরই মো. মোবিন ও মো. শওকত নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তারা দিদার-মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।