আওয়ামী লীগে নারী প্রার্থী মাত্র ২, বিএনপিতে ৪

ঢাকার দুই সিটির ১২৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে মাত্র দুজন নারীকে কাউন্সিলর পদে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি সমর্থন দিয়েছে চার নারী প্রার্থীকে। এবার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো নারী মেয়র প্রার্থীও নেই। কোনো দল নারীদের মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও কেউ নির্বাচন করছেন না।

বড় দুই দলের প্রার্থীসহ এবার সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৮ নারী। এর আগে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই সিটির সাধারণ ওয়ার্ডে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৩ জন। সে হিসাবে এবার নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। যদিও গত নির্বাচনের চেয়ে এবার ওয়ার্ড বেড়েছে ৩৬টি।

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি এখনো মুখে মুখেই রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নারী প্রার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। আবার নারীরা নিজেরাও সরাসরি ভোটযুদ্ধে না নেমে সংরক্ষিত ওয়ার্ড বা সংরক্ষিত সংসদীয় আসনের দিকেই বেশি আগ্রহ দেখান। নারীদের আর্থিক ক্ষমতা কম হওয়াও নারী প্রার্থীর সংখ্যা কম হওয়ার একটি কারণ বলে তাঁরা মনে করছেন।

৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। ঢাকা উত্তরে ৫৪টি ও দক্ষিণে ৭৫টি মিলে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। গত বৃহস্পতিবার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাই শেষ হয়েছে। প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণ ওয়ার্ডের নারী প্রার্থীদের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ—দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের একজন ও বিএনপির দুজন প্রার্থীকে দলীয় সমর্থন দিয়েছে। সাধারণ ওয়ার্ডে বড় দুই দল সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ নারী।

ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহিদা তারেক প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নারীরা এলে পুরুষ প্রার্থীরা তা মেনে নিতে পারেন না। পুরুষ প্রার্থীরা যেকোনো উপায়ে জিততে চান। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীকে হারাতে এমন সন্ত্রাসী কাজ শুরু করেন যে নারীর আর জয়ী হওয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে নারী প্রার্থীরা সাধারণ ওয়ার্ডে নির্বাচন করতে আগ্রহী হন না।

বিএনপি গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ১২৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দল-সমর্থিত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষিত ওয়ার্ডে যত নারী নির্বাচন করছেন, সে হিসাবে নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। সাধারণ ওয়ার্ডে অনেক নারীই প্রার্থী হতে চেয়েছেন, কিন্তু যেহেতু সুযোগ আছে, তাই তাঁদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে।

ঢাকা উত্তরের (ডিএনসিসি) ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে আলেয়া সারোয়ার (ডেইজী) এবং দক্ষিণের (ডিএসসিসি) ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে হেলেন আক্তার আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন। বিএনপির সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা হলেন দক্ষিণের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে শাহিদা মোর্শেদ, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেহেরুন্নেছা, উত্তর সিটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফেরদৌসী আহমেদ (মিষ্টি) এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে সাজেদা আলী (হেলেন)।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৩টি ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে উত্তরের ৩৬টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১২ জন এবং দক্ষিণের ৫৭টি ওয়ার্ডে ১১ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরে ২০১৭ সালে ঢাকার দুই সিটিতে ১৮টি করে নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হয়। এবার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে উত্তরে লড়ছেন ৮ নারী আর দক্ষিণে লড়বেন ১০ নারী।

>

১২৯টি সাধারণ ওয়ার্ড
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে এবার সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলীয় ও স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ১৮ নারী।

ডিএনসিসির ১২ নম্বর ওয়ার্ডে (টোলারবাগ-আহমদনগর) ১৩ বছর ধরে (২০০২-১৫) সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর ছিলেন শিরিন রুখসানা। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে লড়েন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। শিরিনকে হারিয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ইকবাল হোসেন কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এবার শিরিন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। তাঁর স্বামী ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ হোসেনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিরিন রুখসানা। তিনি বলেন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নারী প্রার্থীদের মানতেই চান না পুরুষ প্রার্থীরা। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজের দলের লোকজনই প্রচারকাজ করতে দেয়নি। নানাভাবে প্রচারে বাধা দেওয়া হয়েছে। গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এবার আর সাধারণ কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেননি বলে জানান শিরিন।

নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় শ্বশুরবাড়ির বাধার মুখে পড়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র প্রার্থী সোনিয়া হোসেন। তাঁর প্রয়াত স্বামী আবুল হোসেন দীর্ঘ ১২ বছর নাসিরাবাদের (ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে যুক্ত হওয়া নতুন এলাকা) চেয়ারম্যান ছিলেন। এবার সিটি নির্বাচনে সোনিয়ার ভাশুর আকবর হোসেনও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। আকবর বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন।

সোনিয়া হোসেনের অভিযোগ, হুমকির কারণে এলাকায় যেতে পারছেন না। নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে জীবনের ঝুঁকি মনে করছেন সোনিয়া। তবে তিনি বলেন, হুমকি থাকলেও নির্বাচন করবেন। নির্বাচিত হলে ওয়ার্ডে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াবেন।

সংরক্ষিত ওয়ার্ড
ঢাকা উত্তর সিটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি এবং দক্ষিণ সিটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ড ২৫টি। এসব সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী প্রার্থীরা দলীয় সমর্থন পেয়ে অথবা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেন। এবারের নির্বাচনে উত্তরের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৮৭ জন এবং দক্ষিণে ১০০ জন নারী লড়ছেন। দুই সিটির মোট ৪৩টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী প্রার্থী ১৮৭ জন। পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত দুই সিটির ৩১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ১৮৭ জন। এবার ১২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড বাড়লেও নারী প্রার্থী বাড়েনি।

২০০৮ সালে হওয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব স্তরের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যে দল ব্যর্থ হবে, আইন অনুযায়ী তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বড় দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব এখনো নিশ্চিত হয়নি। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সাল করা হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন নির্বাচন মানেই পেশিশক্তি ও টাকার বিষয়। এ দুটো ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ঘর থেকেও নারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়াও নারীদের নিরুৎসাহিত করে বলে মনে করেন তিনি।
নারী নেতৃত্বের আরও জায়গা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব দলগুলোকেই নিতে হবে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে কাজ করে দলের কর্মী হিসেবে অনেক নারী সংগঠনে ও দলে এগিয়ে থাকেন। কিন্তু মনোনয়ন ও সমর্থন না পেয়ে মূলধারায় থাকতে পারেন না। ফলে রাজনীতিতে ও নির্বাচনে অংশগ্রহণে নারীরা পিছিয়ে থাকছেন।