ঘুষ ঠেকাতে পুলিশ সদস্যের উদ্যোগ

মুস্তাফিজুর রহমান
মুস্তাফিজুর রহমান

১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্র। এতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি ডাম্পিং করা গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যকে টাকা দিতে চাইছেন। কিন্তু পুলিশ সদস্য টাকা না নিয়ে জানান, কাগজপত্র ঠিক থাকলে এমনিতেই কাজ হয়ে যাবে। এতে কিছুটা মন খারাপ করেন টাকা দিতে চাওয়া ব্যক্তি। এরপর নিজেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আবারও টাকা দিতে চান তিনি। এবার পুলিশ সদস্য কিছুটা বিরক্ত হন, অবৈধ লেনদেন অপরাধ জানিয়ে গ্রেপ্তারের কথা বললে তিনি চলে যান।

ভিডিও চিত্রটি মুঠোফোনে ধারণ করে গত বছরের ২২ জানুয়ারি নিজের ফেসবুকে আইডিতে আপলোড করেন শেখ মুস্তাফিজুর রহমান নামের ওই পুলিশ সদস্য। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখেন, ‘ওই ভদ্রলোক পরিবহন খাতের নেতা। পুলিশকে বেকায়দায় ফেলার মূলমন্ত্র ভালো করেই জানেন, তাই চা-পানি খাওয়ার জন্য অবৈধ অর্থ দেওয়ার প্রলোভন দেখান। এরা কিন্তু কোনো পুলিশ পরিবারের না। কিন্তু সব সময় বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় দেন। এঁদের থেকে সাবধান।’ এরপর ভিডিওটি বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও আইডি থেকে শেয়ার হয় একাধিকবার। ফেসবুকে ভিডিওটির ভিউয়ার (দর্শক) সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। পড়ে অসংখ্য লাইক ও ইতিবাচক মন্তব্য (কমেন্টস)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ মুস্তাফিজুর রহমান গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের অপরাধ শাখায় সহকারী শহর উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। মহাসড়কে জব্দ বা ডাম্পিং করা গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন লোকজন আসেন তাঁর কাছে। এ সময় অনেকেই নির্ধারিত সময়ের আগে বা সহজে গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে তাঁকে টাকা (ঘুষ) সাধেন। কিন্তু মুস্তাফিজুর টাকা না নিয়ে ভিডিওগুলো মুঠোফোনে ধারণ করে আপলোড করেন নিজের ফেসবুক আইডিতে। সঙ্গে জুড়ে দেন কিছু জনসচেতনতামূলক ক্যাপশন। তাঁর ফেসবুক আইডিতে এমন ভিডিও পাওয়া গেছে ১৫টি।

ভিডিওচিত্রগুলোর কয়েকটির ক্যাপশন এমন; ‘সাধারণ জনগণ সচেতন হবে কবে!’, ‘পুলিশের সেবা নিন। সাধারণ জনগণকে সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। একটু সচেতন হোন, অবৈধ লেনদেন থেকে বিরত থাকুন’, ‘সাধারণ জনগণ একটু সচেতন হোন। দালাল, গডফাদার ও অবৈধ লেনদেন থেকে বিরত থাকুন’, ‘আমার বিবেকে বাধে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতে। একজন পুলিশ হিসেবে সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতে চাই। সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে চাই।’ 

ভিডিও চিত্রগুলো বিভিন্ন সময় ফেসবুকে তোলার পর থেকেই বাড়তে থাকে ভিউয়ারের সংখ্যা। গত ১০ এপ্রিল আপলোড হওয়া একটি ভিডিও চিত্রের ভিউয়ারসংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। ৫ মের একটি ভিডিওর ভিউয়ার প্রায় পাঁচ লাখ। বাকি ভিডিওগুলোরও একই চিত্র।

সম্প্রতি গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় মুস্তাফিজুরের সঙ্গে। ফেসবুকে ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনো সাধারণ মানুষের ধারণা পুলিশের কাছে কোনো কাজের জন্য গেলে টাকা লাগে বা পুলিশ টাকা ছাড়া কাজ করে না। এ কারণে অনেকেই পুলিশের কাছে আসার আগে টাকা নিয়ে ভাবেন। বিষয়টি দুঃখজনক। কিন্তু আমি যখন কোনো প্রকার টাকা ছাড়া কাজ করে দিই, তখন তাঁরা খুব অবাক হন, কেউ কেউ আবেগে কেঁদে ফেলেন। বিষয়টি আমাকে ভাবায়। পরে মনে হলো, এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা দরকার। আর সে জন্য প্রথমে আমার টেবিলের (অপরাধ শাখার ডেস্ক) সামনে ডাম্পিং করা গাড়ি ছাড়াতে কোনো টাকা লাগে না বা অবৈধ লেনদেন অপরাধ জানিয়ে একটি নোটিশ লাগাই। কিন্তু গাড়ি নিতে আসা অনেকেই লেখা পড়তে পারে না বা খেয়াল করে না। পরে বিকল্প হিসেবে বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ফেসবুকের আশ্রয় নিই।’

মুস্তাফিজুর বলেন, ‘পুলিশ ও সাধারণ মানুষ যাতে কিছুটা সচেতন হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে থেকে ভিডিওগুলো করা। আর আমার এ কাজে সাহস জুগিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের সাবেক পুলিশ সুপার শফিউল ইসলাম স্যার। কাজের স্বচ্ছতা আনতে তাঁর অনুমতি নিয়েই ভিডিওগুলো করা।’

শফিউল ইসলাম বর্তমানে কর্মরত আছেন বাংলাদেশ নৌপুলিশে। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্র চলে একটি নির্দিষ্ট আইনে। সড়ক থেকে গাড়িগুলোও জব্দ করা হয় একটি আইনের বলেই। কিন্তু কেউ একটা অনৈতিক আবদার নিয়ে এল আর আমি তার কথা শুনে গাড়ি ছেড়ে দিলাম, তাতে আইন প্রতিষ্ঠিত হবে না। আইন কী পারমিট করে আর কী করে না, এটা মানুষকে জানতে হবে, সচেতন হতে হবে। শুধু টাকা দিয়েই সব হয় না, এটা মানুষকে বোঝাতে হবে। সেই নৈতিকতা থেকে আমিই তাঁকে (মুস্তাফিজুর) ক্যামেরা লাগাতে বলেছিলাম। পরে সে এটা ফেসবুকে আপলোড করে।’