অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নকশা করা কাঠের দরজা। শুক্রবার লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে।  ছবি: প্রথম আলো
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নকশা করা কাঠের দরজা। শুক্রবার লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে। ছবি: প্রথম আলো

অযত্ন–অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে সংরক্ষণ করা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীদের হাতে তৈরি নকশিকাঁথা, সিন্দুক, কাঠের খাট, নকশি কাঠের দরজাসহ বিভিন্ন পুরোনো নিদর্শন।

জানা যায়, দেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, প্রদর্শন ও পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালীন সরকার বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত করে।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ১৯৯৮ সালের আইনের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের কার্যাবলিতে যেসব শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হবে ঐতিহাসিক এবং লোক ও কারুশিল্পের সংরক্ষণ করা, কারুশিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা, ফাউন্ডেশনের ভেতরে একটি শিল্প গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা, লোক ও কারুশিল্প বিষয়ে গবেষণার ব্যবস্থা করা, দেশি–বিদেশি লোক ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণসহ কারুশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চারু ও কারুশিল্পীদের অভিযোগ, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ তাদের এসব কাজের অধিকাংশেরই বাস্তবায়ন করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফাউন্ডেশনের ভেতরে শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। এ জাদুঘরে তিনটি গ্যালারি রয়েছে। নিচতলায় কাঠ খোদাই গ্যালারিতে কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। দোতলায় জামদানি নকশিকাঁথা গ্যালারিতে সোনারগাঁয়ে তৈরি জামদানি শাড়ি ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি বৈচিত্র্যময় নকশিকাঁথা প্রদর্শন করা হয়েছে। এ জাদুঘরটি ছাড়াও ফাউন্ডেশনের ভেতরে বড় সরদারবাড়ি জাদুঘর রয়েছে।

এলাকাবাসী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন পরিদর্শনে আসা পর্যটকেরা অভিযোগ করে বলেন, সরকার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিল, ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তেমন কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে না। কর্তৃপক্ষের অযত্ন ও অবহেলার কারণে ফাউন্ডেশনের পুরোনো অনেক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এখন ধ্বংসের পথে।

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ছাপা হওয়া ২০১৮ সালের স্মরণিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সংগ্রহ করা পুরোনো নিদর্শন রয়েছে পাঁচ হাজার। 

গত শুক্রবার শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ও সরদারবাড়ি জাদুঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, সংরক্ষণের অভাব ও অযত্ন–অবহেলায় নকশি কাঠের দরজা, কাঠের খাট ঘুণ ও উইপোকায় খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, ফাউন্ডেশনের গুদামে রক্ষিত শতাধিক বিভিন্ন পুরোনো নিদর্শনের অধিকাংশ উইপোকা ও ঘুণে খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে।

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন পরিদর্শন আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নজরুল ইসলাম বলেন, ‘লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের অযত্ন–অবহেলা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তারা ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক আহমেদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাদুঘরের ভেতরে প্রয়োজনীয় জায়গার অভাবে আমরা নকশিকাঁথাসহ অন্যান্য পুরাকীর্তি প্রদর্শন করতে পারছি না। যেসব পুরাকীর্তি ইতিমধ্যে নষ্ট হওয়ার পথে, জাদুঘরের ভবনের কক্ষ বৃদ্ধি করে দ্রুত সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ফাউন্ডেশনের গুদামে কিছু পুরাকীর্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। এসব পুরাকীর্তির তালিকা তৈরির কাজ চলছে।’