বাসায় ঢুকে সারওয়ার আলীকে সপরিবার হত্যার চেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত রোববার রাতে তাঁর উত্তরার বাড়িতে ভয়াবহ এ ঘটনা ঘটে। সারওয়ার আলী ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ও চিকিৎসক। তাঁর ধারণা, জঙ্গিগোষ্ঠী এই কাজ করেছে।

দুর্বৃত্তরা সারওয়ার আলীর স্ত্রী কমিউনিটি ক্লিনিকের সাবেক প্রকল্প পরিচালক মাখদুমা নার্গিস, তাঁদের মেয়ে সায়মা আলী, জামাতা হুমায়ুন কবিরকেও হত্যার চেষ্টা চালায়। তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসা দুই প্রতিবেশীকেও ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা।

হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত-পরিচয় চার–পাঁচজনকে আসামি করে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় গতকাল সন্ধ্যায় মামলা করেছেন সারওয়ার আলী।

পুলিশ বলছে, পুরো ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাড়ির দারোয়ান হাসানকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, গত রোববার রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে অজ্ঞাতপরিচয় দুই দুর্বৃত্ত উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে সারওয়ার আলীর বাড়িতে ঢোকে। তারা ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় গিয়ে তাঁর মেয়ে সায়মা আলীর বাসার দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে দেওয়া হলে দুর্বৃত্তরা ভেতরে গিয়ে সারওয়ার আলীর মেয়ে ও জামাতাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালায়। পরে বাড়ির চতুর্থ তলায় গিয়ে সারওয়ার আলী ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে। এ সময় তাঁদের চিৎকারে ওই ভবনের এক বাসিন্দা ও প্রতিবেশীরা এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পুলিশ ওই বাসা থেকে দুর্বৃত্তদের ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন, একটি ব্যাগে থাকা সাতটি চাপাতি, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র, টিভি ক্যামেরার স্ট্যান্ড, সিনথেটিক দড়ি ও কেমিক্যাল স্প্রে উদ্ধার করেছে।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সারওয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, দুর্বৃত্তদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর হবে। তারা প্রথমে তাঁর মেয়ের বাসায় ঢুকেছিল। দুর্বৃত্তরা তাঁর মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ঠিক ওই সময় তাঁর জামাতা এগিয়ে এলে তাঁকেও জিম্মি করে। পরে দুর্বৃত্তরা ভবনের চতুর্থ তলায় গিয়ে সারওয়ার আলী ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে।

সারওয়ার আলী বলেন, ‘দুর্বৃত্তরা আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা চালায়। আমার স্ত্রী এগিয়ে এলে তাঁকেও ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালায় তারা। তখন তিনতলা থেকে আমার মেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করে। তারা বাঁচার জন্য চিৎকার করে। এরই মধ্যে দোতলার ভাড়াটে শাহাবুদ্দিন চাকলাদার ও তাঁর ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার এগিয়ে আসেন। এরপর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ফোন করার চার মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তাঁর সন্দেহ, ভবনের দারোয়ান হাসানের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের যোগসাজশ রয়েছে। সে আগে থেকেই বাড়ির ফটক খোলা রেখেছিল।

সারওয়ার আলীর মেয়ে সায়মা আলী থাকেন ওই ভবনের তৃতীয় তলায়। গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে জানান, দুর্বৃত্তরা তৃতীয় তলায় তাঁর বাসায় ঢুকে তাঁকে প্রথমে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। এ সময় তাঁর স্বামী এগিয়ে এলে তাঁকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। তাঁদের ১৩ বছরের মেয়ে এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলে তাকেসহ তিনজনকে ছুরি ধরে জিম্মি করে বসার ঘরের এক কোনায় আটকে রাখা হয়। দুর্বৃত্তদের একজন তাঁদের ঘিরে রাখে আর ফোন করে দলের লোকজনকে ডাকতে থাকে। এ সময় অন্য দুর্বৃত্তরা ওপর তলায় গিয়ে তাঁর মা ও বাবাকে হত্যার চেষ্টা করে। চারতলা থেকে তখন অনেক শব্দ হচ্ছিল, এ সময় তাঁদের জিম্মি করে রাখা দুর্বৃত্তটি দরজা খুলে দেখার চেষ্টা করলে তাকে ধাক্কা মেরে দরজা বন্ধ করে দেন তাঁরা। এরপর ৯৯৯–এ ফোন করে তাঁরা পুলিশের সহায়তা চান এবং ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ চিৎকার করতে থাকেন।

সারওয়ার আলীর স্ত্রী মাখদুমা নার্গিস বলেন, দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুরি হাতে একজন লোক ভেতরে ঢুকে সারওয়ার আলীকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তাঁর বুকের ওপর চড়ে বসে। এরপর তিনি এগিয়ে গেলে তাঁকেও ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় তিনি পা দিয়ে পাশের টেবিলে জোরে লাথি দিচ্ছিলেন যাতে শব্দ হয়। তিনি প্রাণপণ চিৎকারও করছিলেন। সেই চিৎকার শুনে দোতলা থেকে শাহাবুদ্দিন ও তাঁর ছেলে এগিয়ে আসেন।

 দোতলার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন চাকলাদার বলেন, চিৎকার শুনে তিনি ও তাঁর ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার চারতলায় গিয়ে দেখেন, এক দুর্বৃত্ত সারওয়ার আলী ও মাখদুমা নার্গিসের শরীরের ওপর দুই পা দিয়ে বসে আছেন। তখন তিনি ধমক দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে ওই দুর্বৃত্ত তাঁকে ও তার ছেলের হাতে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় তাঁর ছেলে টেবিলের কাচ ছুড়ে মারার চেষ্টা করলে দুর্বৃত্ত পালিয়ে যায়।

পরে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ওই বাড়ির পার্কিং স্থল থেকে একটি স্ক্রু ড্রাইভার, ব্যাগে থাকা সাতটি চাপাতি, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র, টিভি ক্যামেরার স্ট্যান্ড, সিনথেটিক দড়ি ও একটি কেমিক্যাল স্প্রে উদ্ধার করে।

উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ জানায়, বাড়ির দারোয়ান হাসানের কাছ থেকে একটি মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছে। ফোনটি ছিল মাখদুমা নার্গিসের গাড়িচালক নাজমুলের, সেটি দারোয়ান হাসান ব্যবহার করছিলেন। হামলার দিন দারোয়ানের ওই ফোনে অন্তত ২৫টি কল এসেছিল।

সারওয়ার আলীর স্ত্রী জানান, কিছুদিন আগে তিনি তাঁর গাড়িচালক নাজমুলকে সেনানিবাসের রাস্তা ব্যবহার করতে বলেন। কিন্তু তিনি ওই রাস্তা ব্যবহার করতে আপত্তি জানান। পরে বাসায় ফিরে নাজমুল আর চাকরি করবেন না বলে চলে যান। তিনি বলেন, বাসার কোনো কিছু খোয়া যায়নি।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যায় সারওয়ার আলী বাদী হয়ে বাড়ির দারোয়ান হাসান, তাঁদের সাবেক গাড়িচালক নাজমুলসহ অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। হামলার কারণ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।