সাংসদদের ভূমিকা: আইন প্রণয়নকাজে অনাগ্রহ

জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি
জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি

জাতীয় সংসদ সদস্যদের অন্যতম প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু এ কাজে বেশির ভাগ সাংসদের তেমন আগ্রহ নেই। ঘুরেফিরে হাতে গোনা কয়েকজন সাংসদ আইন প্রণয়নের কাজে সক্রিয়। বাকিদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম চারটি অধিবেশনে পাস হওয়া ১৩টি আইন (বাজেট–সম্পর্কিত তিনটি আইন বাদে) প্রণয়ন কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনসহ মোট সাংসদ ৩৫০ জন। দেখা গেছে, এই ১৩টি আইন করার ক্ষেত্রে মাত্র ১৪ জন সাংসদ বিলের ওপর নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। আর এই ১৪ জনের মধ্যে আটজন সংশোধনী প্রস্তাব এনেও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ সাংসদদের মাত্র ৪ শতাংশ আইন প্রণয়নের আলোচনায় সক্রিয় ছিলেন। যাঁরা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের ১০ জন জাতীয় পার্টির (জাপা), ৩ জন বিএনপির এবং ১ জন গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ।

 চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বিরোধী দলেরই আইন নিয়ে বেশি সক্রিয় থাকার কথা। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সেটা হচ্ছে না। আর সরকারি দলের সদস্যরা হয়তো মনে করেন, আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় পাস হয়ে এসেছে, তাই এর বিপক্ষে কিছু বলা ঠিক হবে না। যদিও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ (দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিধান) এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটিতে বিল নিয়ে আলোচনা হয়। এ কারণেও হয়তো বিল নিয়ে অধিবেশনে কম আলোচনা হয়। কিন্তু যত বেশি আলোচনা হবে, ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা তত কমবে এবং তত বেশি জনস্বার্থে যাবে।

আইন প্রণয়নের আলোচনায় বেশি সক্রিয় হওয়ার কথা প্রধান বিরোধী দলের। চলতি বছরের প্রথম চারটি অধিবেশনের আইন প্রণয়ন কাজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৬ জন সাংসদের মধ্যে ১০ জন নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।

এ বছর জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম সর্বোচ্চ ১০টি বিলে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। এর বাইরে জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক, রওশন আরা মান্নান, পীর ফজলুর রহমান সাতটি করে বিলে নোটিশ দিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া জাপার রুস্তম আলী ফরাজী (৪টি), শামীম হায়দার পাটোয়ারি (৩টি), সালমা ইসলাম (২টি), বেগম নাজমা আক্তার (৩টি), লিয়াকত হোসেন (১টি), বিএনপির রুমিন ফারহানা (৫টি), মোশাররফ হোসেন (৪টি), হারুনুর রশীদ (২টি) এবং গণফোরামের মোকাব্বির খান (৫টি) নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তবে তাঁদের কোনো প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। সব কটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। ফখরুল ইমাম একাধিক বিল উত্থাপনেও আপত্তি তুলেছিলেন। তবে সেগুলো নাকচ হয়েছে।

বিলে সংশোধনী প্রস্তাব এসেছে আরও কম। মাত্র আটজন সাংসদকে বিলের দফাওয়ারি সংশোধনী প্রস্তাব করে আলোচনায় অংশ নিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ফখরুল ইমাম ১০টি, কাজী ফিরোজ রশীদ ৭টি, পীর ফজলুর রহমান ৭টি, মুজিবুল হক ৬টি, রওশন আরা মান্নান ৪টি, রুমিন ফারহানা ২টি, শামীম হায়দার পাটোয়ারি ও সালমা ইসলাম ২টি করে বিলে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। এর মধ্যে ফখরুল ইমাম, ফিরোজ রশীদ, রুমিন ফারহানা, রওশন আরা ও পীর ফজলুর একাধিক সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়।

জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনসভার মূল কাজই আইন তৈরি করা। কিন্তু আইন প্রণয়নের কাজটি খুব খাটুনির কাজ। আইনের খসড়ার খুঁটিনাটি বিস্তারিত পড়তে হয়, জানতে হয়। মন্ত্রিসভায় খসড়া পাস হওয়ার পর থেকেই নজর রাখতে হয়। এই খাটুনির কাজে অনেকে আগ্রহ পান না। তিনি বলেন, ভারতের লোকসভায় বিরোধী দল খুবই ক্ষুদ্র। তারপরও সেখানে নাগরিকত্ব আইন পাস করতে সাত ঘণ্টা সময় লেগেছে। জাতীয় সংসদে এখন স্বল্প সময়ে আইন তৈরি করা হয়। অনেক সময় মন্ত্রীরা বলেন, আইনটি মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়ে এসেছে, তাই জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

২০১৯ সালে যে আইনগুলো পাস হয়েছে, সেগুলো হলো ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, চিটাগং হিলট্র্যাক্টস (ল্যান্ড অ্যাকুইজেশন) রেগুলেশন (সংশোধনী) আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধনী), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় আইন, উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইন, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আইন, বীমা করপোরেশন আইন, প্রাণিকল্যাণ আইন, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল আইন, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) সংশোধন আইন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (সংশোধন) আইন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (সংশোধন) আইন।

সংসদে এই প্রক্রিয়ার আগে মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে বিল নিয়ে আলোচনা হয়। তবে বেশির ভাগ সময় কমিটির ১০ সদস্যের সবাই অংশ নেন না। বিলে খুব একটা পরিবর্তনও আসে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটিতে বিল নিয়ে আলোচনা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সব সময় খুব বড় ধরনের আলোচনা হয়, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো আলোচনা হয়, আগে বেশি হতো। এখন অবশ্য বিরোধী দল সংসদে বিল নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলে। তবে সরকারি দলের ক্ষেত্রে একটি মানসিক বাধা কাজ করে। 

সরকারি দলের সদস্যদের বিলের ওপর নোটিশ বা সংশোধনী দিতে বাধা নেই। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগের ৩০১ জন সাংসদের কেউ কোনো নোটিশ বা সংশোধনী প্রস্তাব আনেননি। একইভাবে ওয়ার্কার্স পার্টি (চার সাংসদ), জাসদ (দুজন) বিকল্পধারা (দুজন), তরীকত ফেডারেশন (একজন) ও জাতীয় পার্টির (জেপি) ও চার স্বতন্ত্র সাংসদদের কাউকে নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে দেখা যায়নি। তাঁরা বিল উত্থাপন ও পাসের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে আবশ্যিকভাবে আইন প্রণয়ন কাজে অংশ নিতে হয়।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারদলীয় সদস্যদের বিলের ওপর নোটিশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বিলগুলো সংসদীয় কমিটি হয়ে আসে। সেখানে সাংসদেরা আলোচনা করেন। এরপরও সংসদে অনেক সংশোধনী গ্রহণ করা হয়।

জাতীয় সংসদ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বাংলাদেশের দশম সংসদ (২০১৪-২০১৯) নিয়ে সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যায়, দশম সংসদে মোট সময়ের ১২ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল আইন প্রণয়নের কাজে। ২০১৪-২০১৯ সময়কালে ভারতের লোকসভা আইন প্রণয়নে ৩২ শতাংশ সময় ব্যয় করে। আর ২০১৬-২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে প্রায় ৪৮ শতাংশ সময় আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ব্যয় হয়।

দশম সংসদে পাস হওয়া বিলের সময় বিশ্লেষণ করে টিআইবি বলেছে, এই বিলগুলো উত্থাপন এবং বিলের ওপর সদস্যদের আলোচনা এবং মন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিল পাস করতে গড়ে সময় লেগেছে প্রায় ৩১ মিনিট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ বিল পাসে ১ থেকে ২০ মিনিট, ৪৫ শতাংশ বিল পাসে ২১ থেকে ৪০ মিনিট, ৮ শতাংশ বিল পাসে ৪১ থেকে ৬০ মিনিট ও ১ শতাংশ বিল পাসে ৬০ মিনিটের বেশি সময় লেগেছে। দশম সংসদের ৭১ শতাংশ বিল ৩০ মিনিটের মধ্যে পাস হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতে ১৬তম লোকসভায় বিল পাসের ক্ষেত্রে আলোচনায় প্রতিটি বিলে গড়ে প্রায় ১৪১ মিনিট ব্যয় হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদের তিনটি দায়িত্ব—জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা, সরকারের জবাবদিহি এবং আইন প্রণয়ন। আইন প্রণয়নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ কাজে সাংসদদের অনাগ্রহ বিব্রতকর। এ কাজে তাঁদের আগ্রহের ঘাটতি, নাকি দক্ষতার ঘাটতি আছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া সবাই আইন প্রণয়নের কাজে অংশ নেবেন, সেটা নয়। কিন্তু বিশালসংখ্যক সদস্যের অনাগ্রহ অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।