নদী রক্ষায় গবেষণাগার

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে রাখা একটি মা মাছ হাতে শিক্ষক ও গবেষক মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া।  সৌরভ দাশ
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে রাখা একটি মা মাছ হাতে শিক্ষক ও গবেষক মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া। সৌরভ দাশ

হালদার যেন দুঃখের শেষ নেই। নদীর বুক চিরে চলে ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার। উত্তোলন করা হয় বালু। নদীতে কখনো শিল্পকারখানার, কখনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য এসে পড়ে। নগরের গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা বিভিন্ন খাল হয়ে মিশে যায় নদীর পানিতে। প্রকৃতিবিনাশী এসব অত্যাচারে ওষ্ঠাগত নদীর প্রাণ। বিপন্ন হতে থাকে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রের প্রাণবৈচিত্র্য।

নদীর এই কান্না স্পর্শ করে নদীঅন্ত প্রাণ কিছু মানুষকে। তাঁরা সক্রিয় হন নদী রক্ষায়। তাঁদেরই একজন মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া। হালদার আনন্দ-বেদনায় সব সময়ের সঙ্গী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি’। হালদার ওপর দাঁড়িয়ে দেশের সব নদীকে রক্ষার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই গবেষণাগার।

২০১৭ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদের তিনতলার একটি পরিত্যক্ত কক্ষে এই গবেষণা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সহযোগিতা দেয় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)।

দেশের একক কোনো নদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত হালদা নদী গবেষণা কেন্দ্র গবেষণা আর নদী রক্ষার সচেতনতায় একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছে।

 একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়ির রামগড়ের মানিকছড়িতে। প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীতে প্রতিবছর প্রথম ভারী বর্ষণের সময় (যখন বজ্রপাত হয়) মা মাছ ডিম ছাড়ে।

যাত্রা শুরুর গল্প

গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠার কারণ জানিয়ে মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আগের প্রজন্ম হালদা নিয়ে টুকটাক কাজ করেছেন। তাঁরা চলে গেছেন। আমরাও একদিন চলে যাব। তার মানে কি হালদা গবেষণা থেমে যাবে? এটি চলমান রাখতে হলে পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। এই চিন্তা থেকেই গবেষণা কেন্দ্র করা হয়েছে।’

আলাপের ফাঁকে ফাঁকে গবেষণা কেন্দ্রের যাত্রা শুরুর গল্প, সাফল্য, কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, গবেষণা কেন্দ্র করার প্রস্তাব নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে গিয়েছেন তিনি। অধিকাংশই গুরুত্ব দেননি। শেষ পর্যন্ত পিকেএসএফ ও আইডিএফ রাজি হয়। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

মূলত পাঁচটি উদ্দেশ্য নিয়ে এই গবেষণা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হালদা নদীর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিশেষ গবেষণা। হালদা নদীর সম্পদ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। এই গবেষণা কেন্দ্রকে দেশের নদী গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হচ্ছে অন্যতম উদ্দেশ্য।

কী আছে গবেষণা কেন্দ্রে

এক হাজার বর্গফুটের ওপর স্থাপিত এই গবেষণা কেন্দ্রে তিনটি শাখা রয়েছে। বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি শাখায় রয়েছে পানির গুণাগুণ পরীক্ষা এবং নদীর জৈবিক বিশ্লেষণের আধুনিক যন্ত্রপাতি।

নদী জাদুঘর ও আর্কাইভ শাখায় হালদা নিয়ে এখন পর্যন্ত যত ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে তার নথিপত্র, প্রকাশিত প্রবন্ধ, প্রকল্পের কাগজপত্র রাখা হচ্ছে। হালদা নদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বড় আকারের মা মাছ। এর নমুনা, ডলফিন ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে শুধু হালদার নয়, দেশের অন্যান্য নদীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্পদের তথ্যও সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা।

আর তৃতীয় শাখা হচ্ছে ডিজিটাল কনফারেন্স সেন্টার। এখানে বৈজ্ঞানিক আলোচনা, প্রেজেন্টেশন ও ভিডিও-তথ্যচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে।

দুই বছরেই অনেক অর্জন

প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে এই গবেষণাগারের অর্জন বা সাফল্য উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে হালদা নদীর দূষণসহ বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে এই গবেষণাগার।

২০১৮ সালের শুরুর দিকে হালদা নদীতে বিপন্ন প্রজাতির ২১টি ডলফিন মারা যায়। মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে প্রথমবারের মতো ডলফিনের ময়নাতদন্ত হয় এই গবেষণাগারে। এতে বেরিয়ে আসে ড্রেজারের আঘাতে মারা যায় এসব ডলফিন। এরপর বালুমহালের ইজারা বন্ধ, ড্রেজার চলাচল বন্ধসহ পাঁচটি সুপারিশ করলে তা বাস্তবায়ন করে সরকার।

এই গবেষণাগার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয়েছে হালদা নদীদূষণের জন্য দায়ী একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও একটি কাগজ তৈরির কারখানা।

নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে নদী আড্ডা দেন। যেখানে তাঁরা তাঁদের অঞ্চলের নদী নিয়ে আলোচনা করেন।

আছে সীমাবদ্ধতাও

দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে গবেষণাগার। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব। এই বিষয়ে মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, গবেষণাগারে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তা অপ্রতুল। পুরোদমে কাজ করার জন্য আরও অনেক যন্ত্রপাতি দরকার। গবেষণাগারের রক্ষণাবেক্ষণ ও খরচ মেটাতে রীতিমতো বেগ পোহাতে হচ্ছে তাঁকে।

তবে ধীরে ধীরে এসব সমস্যা একদিন দূর হবে বলে আশাবাদী হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া। গবেষণাগার করার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ঘুচেছে আক্ষেপ। এখন তাঁর প্রত্যাশা, এই গবেষণা কেন্দ্র একদিন দেশের নদী রক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হবে।