আলোকিত মানুষ তৈরির পাঠশালা

সিলেট শহরতলির বালুচর এলাকায় ‘আলোকিত পাঠশালা’। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেট শহরতলির বালুচর এলাকায় ‘আলোকিত পাঠশালা’। ছবি: আনিস মাহমুদ

ছোট্ট সরু রাস্তা। উভয় পাশে বেশ কয়েকটি কলোনি। সেই কলোনিসংলগ্ন রাস্তা ধরে যেতে হরহামেশাই শিশুদের পড়াশোনার আওয়াজ পথচারীদের কানে বাজে। সমস্বরে তারা নামতা ও স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ আওড়ায়। শিশুদের পড়ালেখার এমন কার্যক্রম চলছে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। আর এসব শিশুকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদানের কাজটি করে চলেছেন একদল তরুণ-তরুণী।

দুস্থ ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে তরুণেরা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে এখন পড়াশোনা করছে শ্রমিক, রিকশাচালকসহ শ্রমজীবী দরিদ্র পরিবারের ৪০টি শিশু। ‘আলোকিত পাঠশালা’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সিলেট শহরতলির উত্তর বালুচর এলাকায়।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি খোলা উঠানে এ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। চালুর এক বছর পর তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে পাঠশালাটি পরিচালিত হচ্ছে। এখন এখানে তিনজন শিক্ষক নিয়মিত পড়াচ্ছেন। বিদ্যালয়টি সাত সদস্যের একটি কার্যকরী কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। কমিটির সহসভাপতি ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন নিশাত শাহরিয়ার। এ কার্যক্রমের শুরু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তখন সিলেট এমসি কলেজে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। বন্ধুবান্ধব মিলে উত্তর বালুচর এলাকায় প্রায়ই আড্ডা দিই। তখনই কলোনির শিশুদের শিক্ষাহীন বেড়ে উঠতে দেখে সবাই মিলে বিদ্যালয়টি চালু করি। কলোনি ও আশপাশের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের আলোকিত জীবনের সন্ধান দিতেই বিদ্যালয়টি চালু করি।’

নিশাত শাহরিয়ার জানান, বিদ্যালয়ে বই-খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ—সবকিছুই তাঁরা শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে সরবরাহ করে থাকেন। এর বাইরে বিদ্যালয়ের তিনটি কক্ষের ভাড়া, বেঞ্চ-বোর্ডসহ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন, শিক্ষার্থীদের সপ্তাহের তিন দিন খাবার সরবরাহ, বিদ্যালয় পরিচালনাসহ প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। শুরুতে নিজেরাই চাঁদা দিয়ে তাঁরা এ খরচ মেটাতেন। এখন অনেক শিক্ষাহিতৈষী অনুদান দিচ্ছেন। এরপরও আর্থিক সংকটে তাঁরা যথাযথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না। বিভিন্ন সমাজসেবীর অনুদানে শিক্ষার্থীদের প্রতিবছরই রমজান মাসে ঈদের পোশাক, বাজার ও ইফতার এবং কোরবানির মাংস দেওয়া হয়।

বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্লে থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পাঠদান চলছে। তবে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে জমি ইজারা পেলে আলোকিত পাঠশালাকে একটি স্থায়ী বিদ্যালয়ে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চালাতে তাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সম্প্রতি লিখিত আবেদনও করেছেন। চলতি বছর যে পাঁচজন ছাত্রী পাঠশালায় চতুর্থ শ্রেণিতে পাঠরত, তাদের অন্য একটি নিবন্ধিত বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

পাঠশালায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করছেন দুই শিক্ষক। ছবি: আনিস মাহমুদ
পাঠশালায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করছেন দুই শিক্ষক। ছবি: আনিস মাহমুদ

আলোকিত পাঠশালায় ছুটির দিন শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পাঠদান চলে। পড়াশোনার বাইরেও বছরব্যাপী শিক্ষা ও সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি বিদ্যালয়টিতে পালিত হয়। বছরে একবার নির্দিষ্ট সময়ে পার্ক কিংবা দৃষ্টিনন্দন কোনো এলাকায় শিক্ষাভ্রমণে শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়।

বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী কুলসুমা আক্তার জানায়, তার বাবা নেই। মা পার্শ্ববর্তী টিবি হাসপাতালে কাজ করেন। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। কুলসুমা বলে, এখানে স্যার-ম্যাডামরা আদর করেন। স্নেহ করেন। ভালো লাগে পড়তে।

ইলা আক্তার এ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। তার বাবা মাইক্রোবাসের চালক এবং মা গৃহিণী। ৬ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে সে সপ্তম। ইলা বলে, ‘স্কুল চালু হওনের পর আমি ইখানে পড়তাছি। সামনে ফাইভের পরীক্ষা দিমু।’ চতুর্থ শ্রেণির আরেক ছাত্রী মুক্তা আক্তার মণির বাবা সিলিন্ডারের দোকানে এবং মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। মুক্তা জানায়, সে আরও পড়তে চায়। বড় হয়ে ভালো চাকরি করতে চায়।

আলোকিত পাঠশালার কার্যকরী কমিটির সংস্কৃতি ও প্রচার সম্পাদক আনিসা বিনতে করিমা। তিনি এ বিদ্যালয়ে পড়ান। আনিসা জানান, তিনি কিছুদিন পর স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হবেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। নিজের বাসা এই বিদ্যালয় থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন তিনি বাইসাইকেল চালিয়ে এখানে আসেন। শিশুদের পড়াতে তাঁর খুবই ভালো লাগে।

২০১৭ সাল থেকে আলোকিত পাঠশালায় নিয়মিত অনুদান দেন ব্যবসায়ী আবুল খায়ের মো. নোমান। এ ছাড়া তিনি নিয়মিতভাবে অনুদান সংগ্রহ, ফ্রি মিলের ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহে ভূমিকা রাখছেন। আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের ইতিবাচক কর্মতৎপরতা দেখে নিজে থেকেই এখানে অনুদান দিতে আগ্রহী হই। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁদের দরদ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিতে পেরে মনের ভেতর থেকে আমার ভালো লাগা কাজ করে।’