সবজিতে সবুজ চাকলা গ্রাম

কপিখেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক। চাকলা গ্রাম, তারাগঞ্জ, রংপুর। ছবি: রহিদুল মিয়া
কপিখেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক। চাকলা গ্রাম, তারাগঞ্জ, রংপুর। ছবি: রহিদুল মিয়া

‘ধান আবাদোত খালি লস। আলু আবাদও পোষায় না। এই জন্যে চার বছর থাকি মুই সবজির আবাদ করছুং।’ এই কথা রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার চাকলা গ্রামের আলিম উদ্দিনের। সবজি আবাদ করে তিনি লাভের মুখও দেখছেন। বললেন, ‘এবার ১৫ হাজার টাকা খরচ করি ৮০ শতক জমিত মুলা নাগাছনু। খরচ বাদে লাভ হইছে ৬০ হাজার টাকা।’

শুধু আলিমই নন, তাঁর গ্রামের অনেক কৃষকই ধান ও আলুর আবাদে লোকসান করে সবজির চাষে ঝুঁকেছেন। গ্রামটিতে ঢুকলে চারদিকে সবজির খেতই বেশি চোখে পড়ে। যেন সবজিতে সবুজ হয়ে রয়েছে চাকলা গ্রাম।

তারাগঞ্জ সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আলমপুর ইউনিয়নের চাকলা গ্রাম। এ গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষ সারা বছর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজির চাষ করছে। এখানকার খেতগুলো এখন টমেটো, গাজর, ধনেপাতা, শিমসহ শাকসবজিতে ভরে উঠেছে। ফলনও ভালো। এখানকার সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দেলওয়ার হোসেন বলেন, সবজি চাষ করে চাকলা গ্রামের অনেকেই সচ্ছল হয়েছেন। অনেক যুবক বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন। দিনমজুর ও গৃহবধূরাও অভাব দূর করেছেন।

যেন সবুজের সমারোহ। খেত থেকে মুলা তুলছেন কৃষক। চাকলা, তারাগঞ্জ, রংপুর। ছবি: রহিদুল মিয়া
যেন সবুজের সমারোহ। খেত থেকে মুলা তুলছেন কৃষক। চাকলা, তারাগঞ্জ, রংপুর। ছবি: রহিদুল মিয়া

আজ শুক্রবার গ্রামটিতে ঢুকেই চোখে পড়ে মাঠের পর মাঠ সবজিখেত। কেউ খেত থেকে ধনেপাতা, শিম, লাউ, বেগুন তুলছেন, কেউ করছেন পরিচর্যা। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চালা। আধা পাকা বাড়িও আছে বেশ কয়েকটি।

গ্রামটিতে ঢোকার মুখে সিরাজুল ইসলামের বাড়ি। একসময় তিনি দিনমজুরি করতেন। এখন সবজি বিক্রির টাকায় তিনি ৪০ শতক জমি কিনেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছেন। তিনি জানান, ৮ বছর ধরে ৪০ শতক জমিতে সারা বছর ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, ধনেপাতা, টমেটো ও শিমের আবাদ করছেন তিনি। শীতের শুরুতে ভালো ফলন হওয়ায় এখনই প্রায় ৩৯ হাজার টাকা আয় হয়েছে।

স্বামী মারা যাওয়ার পর মনোয়ারা বেগম আলমপুর বাজারে মুড়ি আর মৌসুমি ভাপা পিঠা বিক্রি করতেন। এতে এক বেলার খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। দুই সন্তানকে নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকতে হতো। ৭ বছর আগে বসতভিটার ৬ শতক জমিতে লাউ-শিমের চাষ শুরু করেন। এ লাউ-শিম বিক্রি করে আয় আসে ৫ হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ১২ শতক জমি বর্গা নিয়ে লাউ, টমেটোর চাষ করেন। এবার ২৮ শতকে লাউ, ২০ শতকে বেগুন চাষ করেছেন। বন্ধক নিয়েছেন ৩৫ শতক জমি। আছে একটি গাভি ও ৭টি ছাগল। দুই সন্তানকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন, জানালেন তিনি।

খেত থেকে ধনেপাতা তুলছিলেন আজাহারুল ইসলাম। তিনি ৬০ শতক জমিতে টমেটো, শিম, লাউ, ধনেপাতা চাষ করেছেন। এতে বেশ লাভবান হয়েছেন। চাকরির জন্য না ঘুরে নিজেদের জমিতে ৫ বছর ধরে সবজির চাষ করে মাসে গড়ে ১০ হাজার করে টাকা আয় করছেন। তিনি বলেন, সবজি চাষে তিনি রাসায়নিক সারের ব্যবহার করেন না। জৈব সারই ভরসা। পোকামাকড় দমনে তিনি সেক্স ফেরোমন লিউর (বিশেষ ধরনের ফাঁদ) পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। এতে সবজির ফলন বেশ ভালো হয়। খরচও কম।

জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার বলেন, অন্য ফসলের তুলনায় সবজি চাষে লাভ বেশি। বিষয়টি বুঝতে পেরে চাকলা গ্রামের ধনী-গরিব সবাই সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে সবজির চাষাবাদ ও রোগবালাই দমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।