রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা, প্রধানমন্ত্রী হলেন বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ করান রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।  ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২।  ছবি: অমিয় তরফদার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ করান রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২। ছবি: অমিয় তরফদার

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এলেন। তখন তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। দুদিন পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এই পদ পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা।

১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকেই সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সাময়িক সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্দেশে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, মন্ত্রিসভার হাতেই সব ক্ষমতা থাকবে এবং রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান হবেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে। এই গণপরিষদই সংবিধান রচনা করবে।

১২ জানুয়ারি বিকেলে বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিকেল চারটায় দরবার হলে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধির উপস্থিত ছিলেন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাশাপাশি দরবার হলে প্রবেশ করেন। তাঁদের অনুসরণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যরা। বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু ও বিচারপতি চৌধুরীকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

>

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধু প্রথমে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে শপথ করান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। এরপর রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু ও তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। এর আগে তাজউদ্দীন আহমদ নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্র গ্রহণকালে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন নতুন রাষ্ট্রপতি। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান এবং তাঁকে জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করেন।

পুরো শপথ অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় বাংলায়।

বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সংবাদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হলঘরে সবাই মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি করে উল্লাস প্রকাশ করেন। (সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২)

দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল ‘নয়া সরকার: প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী: মন্ত্রসভার শপথ গ্রহণ: শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী’। ইত্তেফাক-এর শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ’। রাজনৈতিক সংবাদদাতা প্রণীত প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘কোটি কোটি মানুষের অন্তরের অন্তরঙ্গতম বাসনাটিকে পূর্ণতার সোনারঙে প্রদীপ্ত করিয়া জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল বুধবার জননী বাংলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্বপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত হইয়াছেন।’ ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আরও ১১ জন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সে দিনই মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়।

নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তাঁরই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করেছি।’ (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমীন আহমদ)

১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান: প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও বেতার, মন্ত্রিপরিষদ ও সংস্থাপন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম: শিল্প ও বাণিজ্য।

তাজউদ্দীন আহমদ: অর্থ, পরিকল্পনা ও রাজস্ব।

এম মনসুর আলী: যোগাযোগ।

খন্দকার মোশতাক আহমদ: বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ।

আবদুস সামাদ আজাদ: পররাষ্ট্র।

এ এইচ এম কামরুজ্জামান: ত্রাণ ও পুনর্বাসন।

শেখ আবদুল আজিজ: স্থানীয় প্রশাসন ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী: শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

জহুর আহমদ চৌধুরী: শ্রম, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা।

কামাল হোসেন: আইন ও সংসদ, সংবিধান প্রণয়ন।

১৯ জানুয়ারি নতুন তিনজন মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন, যথাক্রমে এম আর সিদ্দিকী, শামসুল হক ও মতিউর রহমান।

১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের প্রথম ১০ পঙ্‌ক্তি জাতীয় সংগীত হিসেবে এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্‌ চল্‌ চল্‌’ জাতীয় সমরসংগীত হিসেবে অনুমোদন করা হয়।

১০ ও ১১ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বৈঠকে গণপরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীকারাগারের রোজনামচা বই দুটিতে বহুবার সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা এসেছে।

তাঁর ছয় দফা কর্মসূচির প্রথম দফায় ছিল, ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত পাকিস্তানে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে।...আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।’

এস এ করিম তাঁর ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের যৌক্তিকতা ছিল এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন।’