দুই হাজার ইটভাটা এখনো দূষণ ছড়াচ্ছে

অভিযানের পরও ইট তৈরি থেমে নেই মুন্সিগঞ্জের ইটভাটাগুলোতে। গতকাল দুপুরে সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর এলাকায়।  ছবি: ফয়সাল হোসেন
অভিযানের পরও ইট তৈরি থেমে নেই মুন্সিগঞ্জের ইটভাটাগুলোতে। গতকাল দুপুরে সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর এলাকায়। ছবি: ফয়সাল হোসেন

বায়ুদূষণে ঢাকা আবার শীর্ষে

এখনো দূষণ ছড়াচ্ছে দুই হাজার ইটভাটা

ইফতেখার মাহমুদ, ঢাকা

পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা ও এর আশপাশের পাঁচ জেলায় ৬২ শতাংশের বেশি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে। কিন্তু এরপরও ঢাকা শহরের বায়ু মানের তেমন উন্নতি হয়নি। গতকাল রোববারও দিনের বেশির ভাগ সময় বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম। এ তথ্য বিশ্বের বায়ু মান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের। প্রতিষ্ঠানটি ২৪ ঘণ্টা ধরে বিশ্বের ৯৫টি বড় শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

শুধু ঢাকা শহর নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ১২টি বড় শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণে পাওয়া চিত্রও বেশ উদ্বেগজনক। সরকারের এই সংস্থা বায়ুর মান পর্যবেক্ষণের তথ্য এক দিন পরপর দেয়। গত শনিবার ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী শহরের বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। আর নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বায়ুর মান ছিল তার চেয়েও খারাপ, মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা শহরের বায়ুর মান ছিল অস্বাস্থ্যকর। অর্থাৎ কোনো শহরের বায়ুর মানই ভালো ছিল না। কিন্তু বছরখানেক আগেও ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়া বাকি শহরগুলোর বায়ুর মান শীতের এই সময়েও মাঝারি থেকে ভালো অবস্থায় ছিল। দিন দিন বেশির ভাগ বড় শহরের বায়ুর মান আরও খারাপ হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গত নভেম্বর মাসের হিসাবে দেশের ৩ হাজারের বেশি অবৈধ ইটভাটার মধ্যে এই ১২টি শহরে রয়েছে ১ হাজার ২৪৬টি। যার মধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশের ৫ জেলায় রয়েছে ৫৫৯টি। গত দেড় বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে মাত্র ৭৩৭টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। এখনো চালু থাকা ২ হাজার ২৬৩টি অবৈধ ইটভাটা দূষণ ছড়াচ্ছে।

 অবশ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ঢাকার চারপাশের অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, ঢাকার বাইরেরগুলো ততটা পাচ্ছে না বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা বলছেন, বায়ুদূষণের জন্য দায়ী অবৈধ ইটভাটার পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণবিষয়ক গবেষক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ইটভাটা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়ার পাশাপাশি আন্তসীমান্ত বাতাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ভারত, নেপাল হয়ে শীতকালে যে বায়ু ও কুয়াশা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, সেখানেও দূষণকারী সূক্ষ্ম বস্তুকণা থাকছে। সেগুলো ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হয়ে উঠছে। ফলে বায়ুদূষণ আর কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের বিষয় হিসেবে থাকছে না। এটি নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উদ্যোগ লাগবে।

 বেশি মনোযোগ ঢাকায়

গত ২৬ নভেম্বর উচ্চ আদালত ঢাকার বায়ুর মান ভালো করতে পাঁচটি জেলার অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর সীমিত জনবল দিয়ে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো করে। গতকাল আদালতে উপস্থাপিত পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও নোটিশের মাধ্যমে ৫ জেলার ৫৫৯টি অবৈধ ইটভাটার মধ্যে ৩৪৯টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইটভাটাগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে আমরা ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোর ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযানে বেশি জোর দিচ্ছি। তবে সারা দেশেও এ অভিযান জোরদার হবে।’ তিনি বলেন, ইটভাটা ছাড়াও বড় বড় নির্মাণকাজের ধুলা এখন বায়ুদূষণের বড় উৎস। ইতিমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা হয়েছে। সামনের দিনে এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরও নেওয়া হবে।

সরকার ২০১৫ সালের পর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই, এমন ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৩৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। আর পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির। এই দুটি শর্তই পালন করেনি, এমন ইটভাটা রয়েছে তিন হাজারের বেশি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী উৎসগুলোর মধ্যে ইটভাটার অবদান প্রায় ৫৮ শতাংশ। এরপরই রয়েছে নির্মাণ ও মেরামতকাজের সঙ্গে আসা ধুলা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে বের হওয়া ধোঁয়া।

দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এমনকি কৃষিজমিতেও কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণ যে শুধু ঢাকা শহরেই হয়, তা তো নয়। দেশের অন্য বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণের অবস্থা ঢাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ফলে সেখানকার অধিবাসীরাও সমান দূষণের শিকার হচ্ছে। ফলে সরকারের উচিত পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সব কটি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা। আর বায়ুদূষণের অন্য উৎস, যেমন নির্মাণকাজের ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া বন্ধেও সমান গুরুত্ব দেওয়া।