বোরো বীজতলা ও আলুর ক্ষতি

সপ্তাহখানেক আগে পড়া বৃষ্টি ও ঘন কুয়াশার কারণে রংপুরের গঙ্গাচড়া ও তারাগঞ্জ উপজেলায় আলুর খেতে ‘লেট ব্লাইট’ রোগ দেখা দিয়েছে। এতে ছত্রাক ধরে পাতা ও কাণ্ড পচে গাছ মরে যাচ্ছে। একই কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় বোরো ধানের বীজতলায় ‘কোল্ড ইনজুরি’ দেখা দিয়েছে। এ কারণে চারা মরে যাচ্ছে।

কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে আলুখেতে ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন চাষিরা। আর কুয়াশার হাত থেকে ধানের চারা বাঁচাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হচ্ছে। অনেক সময় এতেও কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।

কৃষকেরা জানান, রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। রাতভর ঘন কুয়াশা পড়ে। এর ওপর গত সপ্তাহে তিন দিন হালকা বৃষ্টি পড়েছে। এতে আলুখেতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে।

রংপুর সদর উপজেলার মাহিগঞ্জ গ্রামের তনু মিয়া তারাগঞ্জের বালাবাড়ি এলাকায় ৫০ একর জমি ইজারা নিয়ে আলু চাষ করেছেন। গতকাল বুধবার তিনি জমিতে শ্রমিক দিয়ে ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছিলেন।

তনু মিয়া বলেন, ‘আলু নিয়া খুব বিপদে আছি। জীবনের সমস্ত পুঁজি দিয়ে ৫০ একর জমিতে নমলা আলুর চাষ করেছি। কিন্তু খেতে লেট ব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে। দিন দিন এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এ রোগ দমন না হলে আমাকে পথে বসতে হবে।’

মাঝাপাড়া গ্রামের আজিজার রহমান বলেন, ‘৪০ শতক জমিত আলু নাগাছুং। গাছগুলা দেখি মনে হছিল, এইবার বুঝি লাভ হইবে। কিন্তুক গাছগুলার পাতা পচি যাওছে। ওষুধ দিয়াও কাম হয়ছে না।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার বলেন, ঘন কুয়াশা আর বৃষ্টির কারণে আলুখেতে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এখন আবহাওয়া ভালো। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ রোগের বিস্তার ঠেকাতে কৃষকদের ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খেতে ছত্রাকনাশক ওষুধ ছিটানো হলে এ রোগ থাকবে না।

সম্প্রতি গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টা ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা আলুর খেতে ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন।

হাবু কুটিরপাড়া এলাকার ফজলুর রহমান বলেন, তিনি দেড় একর জমিতে আলুর চাষাবাদ করেছেন। এর মধ্যে কিছু স্থানে পাতা মোড়ানো ছত্রাক রোগ দেখা দিয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সরওয়ারুল হক বলেন, চলতি বছর রংপুরে ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ মেট্রিক টন। ছত্রাক দমনে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

টানা শীত ও ঘন কুয়াশায় ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কাজ না হওয়ায় কৃষকেরা ধানের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। শীত থেকে বাঁচাতে অনেক কৃষক পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখছেন। কেউ বীজতলায় বিকেলে পানি দিয়ে পরদিন সকালে তা অপসারণ করছেন।

কোষারাণীগঞ্জ, হাজিপুর, বৈরচুনা ও দৌলতপুর ইউনিয়নের কয়েকজন কৃষক জানান, টানা শীত ও কুয়াশায় তাঁদের বোরো ধানের বীজতলা প্রথমে সাদা, কয়েক দিন পর হলুদ ও সবশেষে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অনেক বীজতলা থোকা থোকা লালচে বর্ণ হয়ে চারা মারা গেছে। অনেক বীজতলায় বীজধান বপন করার পরও অঙ্কুরিত চারাগুলো বেড়ে উঠছে না। বীজতলা বাঁচাতে অনেক কৃষক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন। তাতেও উপকার না পাওয়ায় অনেক কৃষক পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রেখেছেন। আবার কোনো কৃষক সেচ দিয়ে বীজতলায় পানি দিয়ে রাখছেন।

হাজিপুরের ক্ষিদ্রগড়গাঁও গ্রামের মো. আইয়ুব আলী বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বরে ব্রি-২৯ জাতের দেড় মণ ধানের বীজ ফেলেছিলাম। কিন্তু দেড় সপ্তাহ পর চারাগুলো সাদা হয়ে যায়। তিন সপ্তাহ পর দেখছি, বীজতলার কিছু কিছু চারা লালচে হয়ে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে। এবার বুঝি নতুন করে বীজতলা তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই।’

কোষারাণীগঞ্জের ভামদা গ্রামের মোজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বীজতলার বেশির ভাগ চারা নষ্টের উপক্রম হয়েছে। বীজতলার চারা দিয়ে আর ১০-১২ দিন পর বোরো ধান রোপণের প্রস্তুতি চলছে। অথচ চারাই বাঁচাতে পারছি না। এবার বীজসংকটে পড়ব বলে মনে হচ্ছে।’

জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম গোলাম সারোয়ার বলেন, কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকদের সব সময় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কুয়াশা কেটে গিয়ে টানা কয়েক দিন সূর্যের আলো পাওয়া গেলে বীজতলা নষ্টের হাহাকার অনেকটা কমে যাবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর এবং প্রতিনিধি, তারাগঞ্জ, রংপুর ও পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও]