একেকজনের হাসি দেখে মন ভরে গিয়েছিল: ফারিহা

সুবিধাবঞ্চিত শিশু এসেছিল ফারিহার বিয়েতে। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত
সুবিধাবঞ্চিত শিশু এসেছিল ফারিহার বিয়েতে। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত

‘কয়েক দিন পর বিয়ের ব্যস্ততা কিছুটা কমলে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম অনেকেই আমাদের ছবি শেয়ার দিয়েছেন। কিছু অনলাইন পোর্টাল নিউজও করেছে। আমার সঙ্গে কথা হয়নি বলে অনেক নিউজে আমার নামটাও ভুল এসেছে। সব মিলে খুবই অবাক হয়েছি। আমি প্রচার বা শো অফ করতে চাইনি বলে বিষয়টি শুধু দুই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে জানিয়ে করেছিলাম। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদেরও কিছু বলিনি আগে থেকে।’

কথাগুলো বলছিলেন ফারিহা ইসলাম (মুনিয়া)। ১১ জানুয়ারি ফারিহা ও তাঁর স্বামী নাঈমুল হাসানের বিয়ের অনুষ্ঠানের কিছু ছবি নিয়েই ঘটে গেছে এত কিছু। ছবিগুলো কেমন ছিল? একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। কোনো ছবিতে নতুন বউ ছোট ছোট বাচ্চাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছেন, কোনো ছবিতে নতুন বর ও কনের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলেছে ছোট ছোট ১২ জন ছেলেমেয়ে। নতুন ঝকঝকে জামা গায়ের এই শিশুরা সুবিধাবঞ্চিত। অনেকের পরিচয় তারা পথশিশু। বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা অন্য অতিথিদের চেয়ে বেশিই সমাদর পেয়েছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শিশুরা। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শিশুরা। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত

ফারিহা মনে করছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে আগত কোনো বন্ধু পরিজনই হয়তো ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছিলেন। তারপর একজন দুজন করে অনেকের ফেসবুকের পোস্টেই ছবিগুলো জায়গা করে নিয়েছে।

এই পথশিশুদের দাওয়াত দেওয়া এবং ফেসবুকে ছবি ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গেই কথা হলো ফারিহার সঙ্গে। ফারিহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ওই বিভাগেরই শিক্ষক হেলাল উদ্দীনের অধীনে রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করছেন। আর নাঈমুল হাসান কাজ করছেন কোকা–কোলা কোম্পানিতে সেলস অ্যানালিস্ট হিসেবে। তাঁদের বিয়ে হয়েছে পারিবারিকভাবে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় রাজধানীর ইস্কাটনে পুলিশ কনভেনশন সেন্টারে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ১২ জন পথশিশু এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি ছিল। এ ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে যে বাড়তি খাবার ছিল তা–ও পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফাউন্ডেশনের অন্য শিশুদের জন্য।

ফারিহা বলেন, ‘বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখতাম কমিউনিটি সেন্টারের গেটে পথশিশুরা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। তারা অনুষ্ঠান শেষে উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে । মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে আর যা–ই করি বা না করি এই শিশুদের কয়েকজনকে হলেও খাওয়াব। ফেসবুকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পেজটা ফলো করতাম আগে থেকেই। দেখতাম তারা এই শিশুদের নিয়ে কাজ করে। বিয়ের আগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এই শিশুদের দাওয়াত দিই। ১২ জন শিশু যাতে নতুন জামা পরে বিয়েতে আসতে পারে, তাই জামা কেনার ব্যবস্থা করি। আর ওদের নিরাপত্তার জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ওদেরও যাতায়াতের ব্যবস্থা করি।’

ফারিহা ও তাঁর স্বামী নাঈমুল হাসানের সঙ্গে অতিথি শিশুরা। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত
ফারিহা ও তাঁর স্বামী নাঈমুল হাসানের সঙ্গে অতিথি শিশুরা। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত

ফারিহা বললেন, ‘বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথিদের প্রথমে কিছু জানানো হয়নি। এই বাচ্চারা যখন আসে তখন আমি আর আমার স্বামী ওদের স্বাগত জানাতে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বিয়ের দাওয়াতে উপস্থিত অন্য শিশুরা তাদের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়েছে। আমাদের সঙ্গে ছবি তুলেছে। খাবার টেবিলে বসে খেয়েছে। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা মজা করেছে। সব মিলে শিশুরা অভিভূত ছিল। তাদের মুখে যে হাসি ছিল, তার তুলনা হয় না। শিশুদের হাসিমুখগুলো কখনো ভুলতে পারব না। একেকজনের হাসি দেখে মন ভরে গিয়েছিল। জীবনের প্রথম চাকরির টাকা দিয়ে নিজের বিয়েতে এ ধরনের কিছু করতে পারার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে স্বামী ও তাঁর বাড়ির সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাঁরা আমার এই ইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং পাশে ছিলেন বলেই কাজটা করা অনেক সহজ হয়েছিল।’

সুলতানা জান্নাত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াতে শিশুদের আনা–নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বললেন, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে এই পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি বিয়েতে শিশুরা দাওয়াত পেয়েছে। ফারিহা ইসলাম তাঁর বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিলেন, শিশুরা গিয়ে খুব মজা করেছে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়তি খাবার অন্য শিশুদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

সুলতানা জান্নাত আরও বললেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বিয়ের অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরটা দেখতে কেমন হয়, গরম খাবারের স্বাদটা কেমন তা জানে না। বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে এই শিশুরা চুপচাপ হয়ে যায়। চারপাশ দেখতে থাকে। আমাদের পেজে যোগাযোগ করে কেউ এই শিশুদের দাওয়াত দিলে তাদের বলা হয়, এই শিশুদের অবহেলা করা যাবে না। অন্য অতিথিদের মতোই তাদের সঙ্গেও ব্যবহার করতে হবে। আর এই শিশুদের নতুন জামা কিনে দেওয়ার কথাও বলা হয়। নিরাপত্তায় যাতায়াতব্যবস্থার দিকটিও দেখতে বলা হয়। এসব শর্ত মেনেই বিয়েতে অনেকে দাওয়াত দিচ্ছেন।’

অতিথি শিশুদের সঙ্গে ফারিহা ও তাঁর স্বামী নাঈমুল হাসান। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত
অতিথি শিশুদের সঙ্গে ফারিহা ও তাঁর স্বামী নাঈমুল হাসান। ছবি: ফারিহা ইসলামের কাছ থেকে সংগৃহীত

সুলতানা জান্নাত বললেন, ‘অনেকের দাওয়াতে গিয়ে সমস্যাও হয়। অন্য অতিথিরা একসঙ্গে বসতে চান না। অনেকে এই শিশুদের দাওয়াত দেওয়ায় বিরক্তও হন। আবার অনেকে ভাবে লোকদেখানোর জন্য এই শিশুদের দাওয়াত দিচ্ছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, কেউ যদি লোকদেখানোর জন্যও ২০টি শিশুকে ভালো খাবার খাওয়ায়, খাওয়াক। এটি তাদের জন্যই আশীবার্দ হবে। আর এই শিশুদের দাওয়াত দিতে হলে খরচ একেবারে কম হচ্ছে না। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা থেকে কাটছাঁট করে যাঁরা কাজটি করছেন, তাঁরা লোকদেখানোর জন্য করছেন না। আর নিজের বিয়েতে একজন মেয়ে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজটি করতে পারছেন, এটাও কিন্তু অনেক বড় পাওয়া।’

সুলতানা জান্নাত বললেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একটি ইমার্জেন্সি টিম আছে, রাত ১২টার সময়ও বিয়েবাড়িতে বাড়তি খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য ফোন দিলে টিমের লোকজন তা নিয়ে এসে সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোকে দিচ্ছেন।