বিষমুক্ত সবজিতে দিন বদল

সবজিবাগানে ঝুলছে লাউ। সেগুলোর পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক আশরাফুল। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
সবজিবাগানে ঝুলছে লাউ। সেগুলোর পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক আশরাফুল। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই বাবার মৃত্যুতে সাত সদস্যের পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে আশরাফুল ইসলামের ওপর। সংসার সামলাতে কৃষক বাবার ছেলে আশরাফুলও শুরু করের কৃষিকাজ। প্রথাগত ধান চাষ করতে গিয়ে অকালবন্যায় পরপর তিনবার ফসল নষ্ট হয়। ২ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েও থেমে যাননি আশরাফুল। ঘুরে দাঁড়াতে তিনি শরণাপন্ন হন উপজেলা কৃষি অফিসে। তাদের পরামর্শেই শুরু করেন বিষমুক্ত সবজি চাষ।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের বালিকান্দি গ্রামের আশরাফুলের সফলতা পেতে সময় লাগেনি। প্রথম বছরেই পেয়ে যান লাভের দেখা। বিষমুক্ত সবজি চাষ করে আশরাফুল এখন সফল কৃষক। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় বলছে, এই উপজেলায় আশরাফুল বিষমুক্ত সবজি চাষের প্রবর্তক। ২০১৯ সালে উপজেলা বৃক্ষমেলায় সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কারও পান তিনি।

সম্প্রতি বালিকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আশরাফুল নিজের সবজির বাগানে কাজে ব্যস্ত। হাতের কাজ শেষ করে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান তাঁর জীবনের গল্প। ২০০৫ সালে তাঁর বাবা আবদুল বাতির মারা যান। এরপর মা, তিন ভাই, দুই বোন, স্ত্রী মিলে সাত সদস্যের পরিবারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। পরপর তিনবার অকালবন্যায় বোরো ফসল হারিয়ে তিনি যখন দিশেহারা, তখন চাচাতো ভাইদের বলে তাঁদের জায়গায় সবজি চাষ শুরু করেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শে বিষমুক্ত সবজি চাষ করে লাভের দেখা পান। এভাবে বাড়তে থাকে সবজি চাষের পরিধি। ২০১০ সালে তিনি ছোট পরিসরে এই সবজি চাষ শুরু করেন। সফলতা পাওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে তিনি ব্যাপকভাবে সবজি চাষ শুরু করেন। বাবা রেখে গিয়েছিলেন ৪ কেদার (৩০ শতকে ১ কেদার) জমি। এবার তিনি ১২ কেদার জমিতে সবজি চাষ করেছেন। তার মধ্যে ৬ কেদার জমিতে লাউ চাষ করেছেন। ৩ কেদার জমিতে ফুলকপি আর ৩ কেদার জমিতে ব্রুকলি চাষ করেন।

আশরাফুল বলেন, ঘুম থেকে উঠেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবজির খেতে। কাজ বেশি হলে গ্রামের আরও দুই-তিনজন যুবককে বেতন দিয়ে সহযোগী হিসেবে কাজে নেন। এবার সবজি চাষে তাঁর ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এরই মধ্যে ২ লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। আরও ৮-১০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।

আশরাফুলের দেখানো পথ অনুসরণ করে অনেকেই এই পথে হাঁটছেন। তাঁদের মধ্যে একজন গৌস মিয়া জানান, আশরাফুলের কাছ থেকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এবার ৭ কেদার জমিতে সবজি চাষ করেছেন। আশরাফুলের সহযোগিতায় তিনি লাভবান হয়েছেন।

সৌদি থেকে দেশে আসা আশরাফুলের বন্ধু ছইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রবাসে গিয়েও কষ্ট করে যা করতে পারিনি গত পাঁচ বছরে বিষমুক্ত সবজি চাষে আশরাফুল তা করতে পেরেছে। আশরাফুল নিজে বেশি পড়ালেখা করতে না পারলেও ছোট ভাইদের পড়ালেখা শিখিয়েছে। গত বছর একজন সরকারি চাকরিও পেয়েছেন।’

আশরাফুলের ভাই আমির হোসেন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আশরাফুল অনেক কষ্টে সবজি চাষ করে ভাইবোনদের পড়ালেখা ও সংসার খরচ চালিয়েছেন। এখন ১০ কেদার জমি কিনেছেন। গরু কিনেছেন আরও ১২টি। গরুর গোবর থেকে জৈবসার তৈরি করে সবজি খেতে ব্যবহার করেন। ক্ষতিকারক পোকা দমনের জন্য জাদুর ফাঁদ, সেক্স ফেরমোন পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

কলকলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল হাশিম বলেন, আশরাফুল এলাকার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি নিজে সবজি চাষে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশীদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। এখন তাঁর কল‍্যাণে গ্রামের মানুষকে সবজি কিনতে হয় না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশরাফুল এই উপজেলার বিষমুক্ত সবজি চাষের প্রবর্তক। একজন সফল সবজি চাষি হিসেবে আমরা তাঁকে পুরস্কৃত করেছি। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা তাঁকে সহযোগিতা করে থাকি।’