সাতকানিয়ায় ইটভাটার পেটে আস্ত পাহাড়

এখানে ছিল সবুজ পাহাড়। একটু একটু করে তা চলে গেছে ইটভাটার পেটে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লটমনি মৌজার পূর্ব পাশে। গত মঙ্গলবার দুপুরে।  প্রথম আলো
এখানে ছিল সবুজ পাহাড়। একটু একটু করে তা চলে গেছে ইটভাটার পেটে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লটমনি মৌজার পূর্ব পাশে। গত মঙ্গলবার দুপুরে। প্রথম আলো

চুড়ামনি ও লটমনি। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলার সীমান্ত এলাকার ওই দুই মৌজা বছর দশেক আগেও পাহাড়, টিলা ও বনাঞ্চলে একাকার ছিল। সেই পাহাড়, টিলা ও বনের মধ্যেই এখন ছয়টি ইটভাটা। পাহাড় ও টিলার মাটি ব্যবহার করেই তৈরি করা হচ্ছে ইট। এতে সেখানকার সেই পাহাড়, টিলা ও বনাঞ্চলের অস্তিত্ব তেমন চোখে পড়ে না। এরই মধ্যে আস্ত একটি পাহাড় ইটভাটার পেটে চলে গেছে।

সাতকানিয়ার পশ্চিমাংশের চুড়ামনি ও বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব সীমানার লটমনি এলাকায় পাহাড়, টিলা ও বনের পাশেই গড়ে উঠেছে এই কয়েকটি ইটভাটা। স্থানীয় মানুষজনের ভাষ্য, এই ভাটাগুলোর মালিকেরা প্রতিবছর ইট তৈরির মৌসুমে পাশের পাহাড় ও টিলা থেকে মাটি কেটে নিয়ে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। কয়েকটিতে দেদার পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠও। এই অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে পাহাড় ও টিলার অস্তিত্ব মুছে যাবে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুসারে পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তা ছাড়া, কোনো পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে, ঢালে বা তৎসংলগ্ন সমতলে এবং পাদদেশ হতে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কোনো ইটভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরির বিধানও নাই।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর ইট পোড়ানোর মৌসুমে ওই এলাকার ইটভাটাতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছিল। কিছুদিন আগে ভাটামালিকদের নিয়ে পাহাড় বা টিলার মাটি দিয়ে ইট তৈরি না করার জন্য বলা হয়েছে। তারপরও কোনো ভাটামালিক আইন না মেনে কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, লটমনি ও চুড়ামনির প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে পাহাড় ও টিলা ঘেঁষে রয়েছে নিজাম উদ্দিন ঝন্টুর খাজা ব্রিকস, কাজল কান্তি দাশের এমবিএফ ব্রিকস, মোহাম্মদ হাসান লিটনের বিবিসি ব্রিকস, আবুল বশরের আরএমবি ব্রিকস ও মোহাম্মদ করিমের কেএমবি ব্রিকস। এই ভাটাগুলোর পূর্ব পাশে ওসমানের ডিবিএম ব্রিকস। ওই ভাটার পাশেই তারেক নামে আরও একজনের একটি ইটভাটা চালু করা হচ্ছে। পাহাড় ও টিলার গায়ে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কেটে নেওয়ার দগদগে চিহ্ন। কথা বলে জানা গেল, এসব ভাটায় পাশের পাহাড় ও টিলার মাটি দিয়েই শ্রমিকেরা ইট তৈরি করছেন। একটি ভাটায় কয়লার কোনো মজুতই দেখা যায়নি। ওই ভাটায় দেদার পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ।

>

পাহাড়, টিলা ও বনের মধ্যেই এখনো ছয়টি ইটভাটা
পাহাড়-টিলার মাটি ব্যবহার করেই তৈরি করা হচ্ছে ইট
দেদার পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ

রমিজ ও চুন্নু নামের দুজন ইটভাটার শ্রমিক বলেন, পাশাপাশি ভাটাগুলোর কোনোটিতে ইটের কাঁচামাল হিসেবে বাইরের কোনো মাটি আনতে হয় না। পাশের পাহাড় ও টিলার মাটি কেটেই ইট তৈরি করা হয়।

লটমনি মৌজার পূর্ব পাশে এবং চুড়ামনি মৌজার পশ্চিম পাশে একটি পাহাড় ছিল। ২০১৫ সালে এই প্রতিবেদক সেখানে গিয়ে সবুজ পাহাড় দেখতে পান। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে পাহাড়ের অস্তিত্ব দেখা যায়নি বললেই চলে।

২০১৫ সাল। সাতকানিয়া-বাঁশখালী সীমান্তের লটমনি মৌজার পূর্ব পাশে তখনো টিকে ছিল সবুজ পাহাড়টি।  ফাইল ছবি
২০১৫ সাল। সাতকানিয়া-বাঁশখালী সীমান্তের লটমনি মৌজার পূর্ব পাশে তখনো টিকে ছিল সবুজ পাহাড়টি। ফাইল ছবি

স্থানীয় সাবেক এক জনপ্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের আইন অনুসারে পাহাড়, টিলা ও বনাঞ্চলের পাদদেশে ইটভাটা স্থাপনে সম্পূর্ণ বিধিনিষেধ থাকলেও এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে এখানকার ভাটামালিকেরা তাঁদের অবৈধ কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনের লোকজন অদৃশ্য কারণে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ইটভাটার মালিক আবুল বশর ও কাজল কান্তি দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগের বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলার মাটি ব্যবহার করলেও এ বছর পাহাড় থেকে মাটি কাটা হয়নি। তা ছাড়া, পাহাড় থেকে মাটি নিয়ে আমরা খুব বেশি লাভবানও হইনি।’

উপজেলার দেওদীঘি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তা মর্তুজা আলী সিদ্দিকী বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে ইট তৈরির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আগেও জানানো হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়েও পুনরায় জানানো হয়েছে।

এওচিয়া ইউপির চেয়ারম্যান ও পশ্চিম সাতকানিয়া ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ের মাটি ব্যবহার করে ইট তৈরি না করার জন্য তাঁদের একাধিকবার বলা হয়েছে। সম্প্রতি পাহাড়ের মাটি ব্যবহার করবেন না মর্মে তাঁদের কাছ থেকে মুচলেকাও নেওয়া হয়েছে।

সাতকানিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, পাহাড় ও টিলার মাটি কাটার বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ ইটভাটাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।