পল্লী বিদ্যুতে ৯ বছরে ১১৪ কর্মীর মৃত্যু

গত নয় বছরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ১১৪ জন কর্মী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এ সময়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন প্রায় দুই হাজার কর্মী। ঊর্ধ্বতন মহলের গাফিলতি দুর্ঘটনার কারণ বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তবে এসব ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার সকালে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার পুটিখালী গ্রামে লাইন মেরামতের কাজ করতে গিয়ে লাইন টেকনিশিয়ান ফারুক মোড়ল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, লাইন মেরামতের আগে বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ না করে লাইনম্যানকে মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছিল। আর গত সোমবার (২০ জানুয়ারি) শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন লাইন টেকনিশিয়ান মো. নাসিরুদ্দীন। তিনি এখন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

গত বছর ১৬ আগস্ট ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লাইনম্যান শাকিবুল হাসান লাইন মেরামত করতে গিয়ে মারা যান। শাকিবুলের স্ত্রী সালমা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি চাকরির আবেদনপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে। তাঁরা আমার আবেদনপত্রটি নেননি। আর পাওনার ব্যাপারে বলেছেন, সময় লাগবে।’

সারা দেশে আরইবির ৮০টি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ব্যক্তি লাইনম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। দেশের সব থেকে বড় এই বিতরণ সংস্থার বড় কাজটি করেন এসব লাইনম্যান। একাধিক লাইনম্যান প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যখনই ডাক পড়ে, ছুটে যেতে হয় কাজে। 

এসব ব্যাপারে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন আহমদের মতামত জানতে এই প্রতিবেদক দুই দিন তাঁর অফিসে গেছেন। তাঁকে পাওয়া যায়নি। ২৪ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত অনেকবার মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে, ফোন করা হয়েছে। কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আট বছর ধরে তিনিই সংস্থাটির চেয়ারম্যান।

>আরইবির ১,৫০০ গ্রাহকের জন্য লাইনম্যান একজন
এঁরা নিয়মিত দুর্ঘটনায় পড়ছেন
কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি

১৫০০ গ্রাহকের জন্য ১ জন লাইনম্যান

২ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহকের আরইবি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। সেবা নিরবচ্ছিন্ন ও ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার জন্য সব থেকে বেশি সক্রিয় থাকেন লাইনম্যানরা। সংস্থায় লাইনম্যান আছেন ১৮ হাজার। প্রতি ১ হাজার ৫০০ গ্রাহকের জন্য লাইনম্যান ১ জন। 

আরইবি কেন্দ্রীয় অফিস থেকে প্রতিটি সমিতিকে সংযোগের জন্য মাস ও বছরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দায়িত্ব জেলার সমিতি প্রধান বা জিএমের। বাস্তবে মাঠপর্যায়ে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কাজ করেন লাইনম্যানরা। কম ভোল্টেজের সমস্যা ও ক্ষমতার বেশি সংযোগ দেওয়ার কারণে ট্রান্সফরমারের ফিউজ কেটে যায় অথবা বিস্ফোরণ ঘটে। এসব ঘটনা দিন বা রাতে যখনই ঘটুক, মেরামতে ডাক পড়ে লাইনম্যানদের। এতে একজন লাইনম্যান মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁদের ছুটি কম। ঝুঁকি ভাতা কম। ২৪ ঘণ্টা কাজে থাকলেও ওভারটাইম কম। 

ভুক্তভোগী লাইনম্যানরা বলছেন, হাতে রবারের গ্লাভস ও পায়ে রবারের বুট পরে লাইন মেরামতের কাজ করার নিয়ম থাকলেও এসব সরঞ্জাম পরে কাজ করা হয় না। কারণ, এসব সরঞ্জাম পরে কাজ করতে হলে দিনে সর্বোচ্চ ৬–৭টি নতুন সংযোগ বা নষ্ট সংযোগ মেরামত করা যায়। একজন লাইনম্যানকে দিনে ১০ থেকে ১৫টি সংযোগ নিয়ে কাজ করতে হয়। কাজের সময় তাঁরা গ্লাভস বা বুট পরেন না। এটাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। প্রতি মাসে নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে হাতে–কলমে নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ হয় না। 

১১ মাস আগে আরইবির ময়মনসিংহ সমিতিতে সুইচরুমে কর্মরত ছিলেন পলক। অভিযোগ আছে, তাঁকে জোর করে পাঠানো হয় ৩৩ হাজার কেভি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের একটি সমস্যা ঠিক করতে। পলক পানির ভেতর ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে মারা যান পলক।

অভিযোগ করলে শাস্তি

শ্রম আইন অনুযায়ী আরইবিতে ট্রেড ইউনিয়ন করতে বাধা নেই। কিন্তু আরইবিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার অপরাধে এখন পর্যন্ত ৫৮ জনকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনকে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়েছে। 

বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে লাইনম্যান পদে কাজ করতেন আউয়াল হোসেন। ট্রেড ইউনিয়ন করার অভিযোগে প্রথম ঢাকায় কেন্দ্রীয় অফিসে পরে ২০১৬ সালেতে ঠাকুরগাঁও সমিতিতে বদলি করা হয়। প্রথম আলোকে আউয়াল হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ি বরগুনা সদরে। ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে আমাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।’ 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)–এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আরইবিতে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বা পঙ্গু হওয়া সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট তদন্ত ও মৃত্যুর পেছনে যাঁদের গাফিলতি রয়েছে, তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি আনা গেলে এই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হতো।