রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়

প্রাণের ভয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের আগস্টে।  ফাইল ছবি
প্রাণের ভয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের আগস্টে। ফাইল ছবি
>

গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন (গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার)।

উপস্থিত: প্রেসিডেন্ট ইউসুফ; ভাইস প্রেসিডেন্ট সুই; বিচারক তোমকা, আব্রাহাম, বেনৌনা, কান আদো ত্রিনদাদ, দোনোগুই, গাজা, সেবুতিন্দে, বান্দারি, রবিনসন, ক্রাওফোর্ড, জেভোরজিয়ান, সালাম, আইওয়াসাওয়া; অ্যাডহক বিচারক পিল্লায়, ক্রেস; রেজিস্ট্রার গতিয়ের

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আইসিজেতে গত ১১ নভেম্বর মামলা করে গাম্বিয়া। এরপর ১০ ডিসেম্বর থেকে তিন দিনের শুনানি হয়। পরে গত বৃহস্পতিবার আদেশ দিয়েছেন আইসিজে। এই আদেশের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।

জাতিসংঘ সনদে আদালত প্রতিষ্ঠার ৪১ ও ৪৮ ধারা এবং আদালতের নীতিমালার ৭৩, ৭৪ ও ৭৫ ধারা মোতাবেক নিম্নোক্ত আদেশগুলো দেওয়া হচ্ছে:

১. ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে গাম্বিয়া আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানায়।

২. শেষে গাম্বিয়া ‘সবিনয় আবেদন জানায়, আদালত রায় দিন এবং ঘোষণা করুন যে মিয়ানমার:

– গণহত্যা সনদের অধীনে বাধ্যবাধকতাগুলো, বিশেষ করে ধারা ক, গ (১), গ (২), গ (৩), গ (৪), গ (৫), ঘ, ঙ ও চ-এর অধীনের বাধ্যবাধকতাগুলো মিয়ানমার লঙ্ঘন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে;

– এ ধরনের চলমান আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচিত অন্যায় কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো, বিশেষ করে ধারা ক, গ (১), গ (২), গ (৩), গ (৪), গ (৫), ঘ, ঙ ও চ-এর অধীনের বাধ্যবাধকতাগুলো পুরোপুরি মেনে চলবে;

– গণহত্যা চালানো ব্যক্তিদের অবশ্যই ধারা ক এবং চ অনুসারে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচার আদালতের সামনে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে;

– রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যেসব সদস্য গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের স্বার্থে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা মানতে হবে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে তাদের সুরক্ষা প্রদানের মধ্যেই কেবল এই বাধ্যবাধকতা সীমাবদ্ধ থাকবে না, ধারা ক–এর আওতায় গণহত্যা প্রতিরোধে বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে অবিচল থাকতে হবে; এবং

– গণহত্যা সনদ, বিশেষ করে ধারা ক, গ (১), গ (২), গ (৩), গ (৪), গ (৫), ঘ, ঙ ও চ-এর অধীনের বাধ্যবাধকতাগুলো আবার লঙ্ঘিত হবে না মর্মে অবশ্যই আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা দিতে হবে।’

৩. গাম্বিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার ৩৬ ধারার ১ অনুচ্ছেদ এবং গণহত্যা সনদের ঝ ধারা অনুসারে আদালতের অধিক্ষেত্র বা আইনগত অধিকার অনুসন্ধানের আবেদন জানিয়েছে।

৪. আবেদনে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

৫. সবশেষে গাম্বিয়া আদালতের কাছে নিম্নোক্ত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে আদেশ চেয়েছে:

‘ক. ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদের অধীনে মিয়ানমার তাৎক্ষণিকভাবে নিজের সক্ষমতার আওতায় গণহত্যামূলক অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এমন সব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। এগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব ধরনের পদক্ষেপও থাকতে হবে: বিচারবহির্ভূত হত্যা অথবা শারীরিক নির্যাতন; ধর্ষণ অথবা যেকোনো প্রকার যৌন সহিংসতা; বাড়িঘর অথবা গ্রামে অগ্নিসংযোগ; পশুসম্পদ ও জমি বিনষ্ট, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত করা, অথবা অন্য যেকোনো প্রকার নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বা এর কোনো অংশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে;

‘খ. মিয়ানমার, বিশেষ করে নিশ্চিত করবে যে তার সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী অথবা অনিয়মিত সশস্ত্র বিভাগসহ যেকোনো প্রকার সংস্থা ও ব্যক্তি যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, গণহত্যা সংঘটনে প্রত্যক্ষ ও উসকানি, অথবা গণহত্যায় সহযোগিতা না করে।

‘গ. আবেদনে উল্লেখিত ঘটনাবলির সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদি মিয়ানমার ধ্বংস করবে না কিংবা তা প্রাপ্তি অসম্ভব করে তুলবে না। গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো সদস্যের ক্ষতিসাধন করে কিংবা তাঁর পর্যন্ত পৌঁছানো দুর্গম করে অথবা তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেও প্রমাণাদি সীমিত করা চলবে না;

‘ঘ. মিয়ানমার ও গাম্বিয়া নিশ্চিত করবে যে আবেদনের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে চলমান বিতর্ক উসকে দিতে বা তা বাড়াতে কিংবা তা আরও কঠিন করে তুলতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না; এবং

‘ঙ. অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার চার মাসের মধ্যে ওই আদেশ কার্যকরে নেওয়া সব ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া নিজ নিজ তরফ থেকে আদালতকে প্রতিবেদন দেবে।’

৬. আদালত প্রতিষ্ঠার ধারা ৪০–এর ২ অনুচ্ছেদ এবং আদালতের নীতিমালার ধারা ৭৩–এর ২ অনুচ্ছেদ অনুসারে রেজিস্ট্রার তাৎক্ষণিকভাবে আবেদনে অনুরোধ জানানো অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি গাম্বিয়ার আবেদন এবং অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে আদেশ চাওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকেও জানিয়েছেন।

৭. আবেদন এবং অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে আদেশের অনুরোধ প্রসঙ্গে আদালতে হাজির হতে হবে, এমন সব রাষ্ট্রকে ১১ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে।

৮. যেহেতু আদালতে কোনো পক্ষেরই কোনো বিচারক নেই, তাই প্রত্যেক পক্ষকে একজন করে অ্যাডহক বিচারক মনোনীত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গাম্বিয়া নাভানেথেম পিল্লায়কে মনোনয়ন দিয়েছে। আর মিয়ানমার দিয়েছে ক্লস ক্রেসকে।

৯. ১২ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে রেজিস্ট্রার সব পক্ষকে চিঠির মাধ্যমে জানান যে ২০১৯ সালের ১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।

১০. ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে গাম্বিয়া আদালতের কাছে নিম্নোক্ত অতিরিক্ত পদক্ষেপ চেয়ে আবেদন করে, যার একটি অনুলিপি তাৎক্ষণিকভাবে মিয়ানমারকে সরবরাহ করা হয়:

‘রোহিঙ্গাদের যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সে বিষয়সহ তাদের ওপর চালানো গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তকারী জাতিসংঘের সব তথ্যানুসন্ধানী কর্তৃপক্ষকে মিয়ানমারে প্রবেশে এবং তাদের সহযোগিতা করতে মিয়ানমার সরকারকে আদেশ দিতে গাম্বিয়া অনুরোধ জানিয়েছে।’

১১. প্রকাশ্য শুনানিতে অংশ নেন:

গাম্বিয়ার পক্ষে: আবুবকর মারি তামবাদু, পায়াম আখাভান, অ্যান্ড্রু লোয়েনস্টেইন, তাফাদজ পাসিপানোদিয়া, আরসালান সুলেমান, পিয়েরে ডি’আর্জেন্ট, পল রিচলার, ফিলিপ স্যান্ডস। মিয়ানমারের পক্ষে: অং সান সু চি, উইলিয়াম সাবাস, ক্রিস্টোফার স্টকার, ফোয়েবে ওকোওয়া।

১২. শুনানির দ্বিতীয় পর্যায় শেষে গাম্বিয়া আদালতের কাছে নিম্নোক্ত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে আদেশ চায়:

‘ক. ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদের অধীনে মিয়ানমার তাৎক্ষণিকভাবে নিজের সক্ষমতার আওতায় গণহত্যামূলক অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, এমন সব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে;

‘খ. মিয়ানমার, বিশেষ করে নিশ্চিত করবে যে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী অথবা অনিয়মিত সশস্ত্র বিভাগসহ যেকোনো প্রকার সংস্থা ও ব্যক্তি যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, অথবা গণহত্যা সংঘটনে প্রত্যক্ষ ও জন–উসকানি, অথবা গণহত্যায় সহযোগিতা না করে;

‘গ. আবেদনে উল্লেখিত ঘটনাবলির সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদি মিয়ানমার ধ্বংস করবে না কিংবা তা প্রাপ্তি অসম্ভব করে তুলবে না;

‘ঘ. মিয়ানমার ও গাম্বিয়া নিশ্চিত করবে যে আবেদনের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে চলমান বিতর্ক উসকে দিতে বা তা বাড়াতে কিংবা তা আরও কঠিন করে তুলতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না;

‘ঙ. অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার চার মাসের মধ্যে ওই আদেশ কার্যকরে নেওয়া সব ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া নিজ নিজ তরফ থেকে আদালতকে প্রতিবেদন দেবে; এবং

‘চ. রোহিঙ্গাদের যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সে বিষয়সহ তাদের ওপর চালানো গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তকারী জাতিসংঘের সব তথ্যানুসন্ধানী কর্তৃপক্ষকে মিয়ানমারে প্রবেশে এবং তাদের সহযোগিতা করতে মিয়ানমার সরকারকে আদেশ দিতে গাম্বিয়া অনুরোধ জানিয়েছে।’

১৩. শুনানির দ্বিতীয় পর্যায় শেষে মিয়ানমার আদালতের কাছে অনুরোধ জানায়:

‘ক. তালিকা থেকে মামলাটি বাদ দেওয়া হোক;

‘খ. অন্তর্বর্তী আদেশ চেয়ে গাম্বিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হোক।’

১৪. গাম্বিয়া তার আবেদনে ‘গণহত্যা সনদের অধীনে সংরক্ষিত গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সব সদস্যের’ সুরক্ষা চেয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, রোহিঙ্গা মুসলমানেরা ‘নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিসহ নিজেদের আলাদা জাতিগোষ্ঠী মনে করে এবং দাবি করে যে রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সংযোগ রয়েছে’; যদিও ‘মিয়ানমার সরকার ক্রমাগত এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এসেছে, এবং দেশটি রোহিঙ্গাদের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই রাষ্ট্রহীন।

১৫. আদালতের এই আদেশে ‘রোহিঙ্গাদের’ এই জনগোষ্ঠীর দাবি করা পরিচয় এবং রাখাইনের, যা মিয়ানমারের একাংশ, সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগসূত্রের নিরিখে অনুধাবন করতে হবে।

. আদালতের আপাতদৃশ্যে এখতিয়ার

. সূচনা

১৬. আদালত তখনই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ দিতে পারবেন, যদি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব পদক্ষেপে আদালতের অধিক্ষেত্র থাকে।

১৭. বর্তমান মামলায় গাম্বিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার ৩৬ ধারার ১ অনুচ্ছেদ এবং গণহত্যা সনদের ঝ ধারা অনুসারে আদালতের এখতিয়ার অনুসন্ধানের আবেদন জানিয়েছে।

১৮. গণহত্যা সনদের ঝ ধারা অনুসারে:

‘গণহত্যা সনদের গ ধারা অনুসারে গণহত্যা বা এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিগণিত হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে রাষ্ট্রের দায়িত্বসহ সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ অথবা পূর্ণ বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট বিবাদ নিরসনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বিবদমান যেকোনো পক্ষ আবেদন জানাতে পারবে।’

১৯. গণহত্যা সনদে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমার ১৯৫৬ সালে ১৪ মার্চ অনুমোদন দিয়েছে। গাম্বিয়া অনুমোদন দিয়েছে ১৯৭৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর।

. গণহত্যা সনদ ব্যাখ্যা, প্রয়োগ অথবা পূর্ণ বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট বিবাদ

২০. গণহত্যা সনদের ঝ ধারা সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ অথবা পূর্ণ বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট বিবাদে আদালতের শর্ত সাপেক্ষে এখতিয়ার দিয়েছে।

২১. গাম্বিয়া বলেছে যে মিয়ানমারের সঙ্গে তার বিবাদ গণহত্যা সনদের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা এবং এর আওতায় ‘গণহত্যা প্রতিরোধ এবং মিয়ানমারের নিজের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার’ বাধ্যবাধকতা সংশ্লিষ্ট। বিশেষ করে গাম্বিয়া দাবি করেছে যে ২০১৬ সালেরঅক্টোবরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং অন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক ও পদ্ধতিগত ‘জাতিগত নিধন অভিযান’ শুরু করে। এই সময়ে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পুরোটাই অথবা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে গণহারে হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পদ্ধতিগত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যে ক্ষেত্রে অনেক সময়ই অগ্নিসংযোগ করা বাড়ির মধ্যে বাসিন্দাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। গাম্বিয়ার অভিযোগ, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তীকালে মিয়ানমারে ‘জাতিগত নিধন অভিযান’-এর সঙ্গে এ ধরনের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড আরও বৃহত্তর ভৌগোলিক পরিসরে ব্যাপকভাবে অব্যাহত থেকেছে।

২২. গাম্বিয়া বলেছে, মামলার আগে তারা পরিষ্কারভাবে মিয়ানমারকে বলেছে যে তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণহত্যা সনদের অধীনে বাধ্যবাধকতাগুলো লঙ্ঘন করেছে, কিন্তু মিয়ানমার ‘গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের যেকোনো প্রকার অভিযোগের বিরোধিতা ও প্রত্যাখ্যান করেছে’। এই পরিপ্রেক্ষিতে গাম্বিয়া দাবি করেছে যে তারা কয়েক দফায় বহুপক্ষীয় আয়োজনে পরিষ্কারভাবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। মিয়ানমারের গণহত্যা সনদ লঙ্ঘন এবং আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতির কথাও এসব আয়োজনে তুলে ধরেছে গাম্বিয়া। গাম্বিয়া আরও দাবি করেছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশন এ বিষয়ে রাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগ, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও গাম্বিয়ার উদ্যোগ, এবং ‘আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদের আওতায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে’ ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) উৎসাহিত করাকে স্বাগত জানিয়েছে। গাম্বিয়ার তথ্যানুসারে মিয়ানমার তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন ও উপসংহার পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। সবশেষে গাম্বিয়া জোর দিয়ে বলেছে যে তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো লঙ্ঘনের অভিযোগ কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর মিয়ানমারকে পাঠিয়েছে, যার জবাব মিয়ানমার দেয়নি।

২৩. মিয়ানমার দাবি করেছে যে গণহত্যা সনদের ঝ ধারা অনুসারে আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই। দেশটি প্রথমে দাবি করেছে যে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আদালতের প্রক্রিয়ার বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলা দেশটির নিজের তরফ থেকে নয়, বরং ওআইসির ‘পক্ষ থেকে’ একটি ‘ছায়া’ মামলা। মিয়ানমার আরও দাবি করেছে, ১১ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে গাম্বিয়ার আবেদন জমা দেওয়ার আগে দেশটির ১১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের কূটনৈতিক চিঠি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের জবাব না দেওয়ার বিষয়ে যে বিবাদ, তাতে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। মিয়ানমারের মতে, ওই কূটনৈতিক চিঠিতে কোনো জবাব চাওয়া হয়নি, যেহেতু তাতে সুনির্দিষ্টভাবে সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়নি এবং যেকেনো পরিপ্রেক্ষিতেই এ ধরনের জবাব এক মাসের মধ্যে প্রত্যাশাও করা হয় না।

২৪. মিয়ানমার উপসংহার টানে যে বিবাদ যেহেতু নেই, কাজেই আদালতের এখতিয়ার এখানে নেই এবং তালিকা থেকে এই মামলা অপসারণ করা উচিত।

২৫. মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী গাম্বিয়া ওআইসির ‘ছায়া’ হিসেবে কাজ করেছে। আদালত এখানে উল্লেখ করতে চান যে বাদী নিজের নামেই মামলাটি করেছে এবং সনদের আওতায় মিয়ানমারের সঙ্গে তার বিবাদ রয়েছে বলে দাবি করেছে।

২৬. মামলার আবেদন জমা দেওয়ার সময় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো বিবাদ ছিল কি না, তা নিরূপণে আদালত বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো বিবৃতি বা নথি আদান–প্রদান হয়েছে কি না, বহুপক্ষীয় আয়োজনে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, তা আমলে নিয়েছে।

২৭. আদালত উল্লেখ করছেন যে তথ্যানুসন্ধানী মিশন ৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পুনরুল্লেখ করে যে ‘গণহত্যা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্ব রয়েছে মিয়ানমারের’ এবং গণহত্যা সনদের আওতায় আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া, বাংলাদেশ ও ওআইসির মামলা দায়েরের চেষ্টাকে স্বাগত জানায়। ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর গাম্বিয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে বলে যে তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যেতে প্রস্তুত। দুদিন পর মিয়ানমার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বলে যে তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন ‘পক্ষপাতমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ; সত্যের ভিত্তিতে নয়, বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদনটি রচিত’। আদালতের দৃষ্টিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিবদমান পক্ষগুলোর এসব বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটা ঘটনাবলি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

২৮. আদালত গাম্বিয়ার ১১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের কূটনৈতিক চিঠিটিও আমলে নিয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, এই চিঠিতে তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রতীয়মান হয়েছে যে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় ওই চিঠির জবাব না দেওয়াটাও বিবাদের আরেকটি ইঙ্গিত বহন করে।

২৯. বাদীর করা অভিযোগ গণহত্যা সনদের আওতায় পড়ে কি না, তা নির্ণয়ে আদালত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী এবং ব্যক্তি অথবা সত্তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে গাম্বিয়ার বক্তব্য আমলে নিয়েছেন। গাম্বিয়ার অভিযোগ, মিয়ানমার গণহত্যা সনদের অন্য বাধ্যবাধকতাগুলোও লঙ্ঘন করেছে। মিয়ানমার গাম্বিয়ার করা গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

৩০. এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ দিতে আদালতের যা প্রয়োজন তা হলো, গাম্বিয়ার করা অভিযোগ গণহত্যা সনদের আওতার মধ্যে পড়ে কি না, তা নিরূপণ করা। আদালতের দৃষ্টিতে, গাম্বিয়ার করা অভিযোগগুলোর অন্তত কয়েকটি অবশ্যই গণহত্যা সনদের আওতায় পড়ে।

৩১. উল্লিখিত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে আদালত মনে করেন, গণহত্যা সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ অথবা পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে প্রাথমিক আদেশ দেওয়ার যথেষ্ট এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।

. সনদের জ ধারা অনুযায়ী মিয়ানমারের সংরক্ষণ

৩২. মিয়ানমার দাবি করেছে যে গণহত্যা সনদের জ ধারার কারণে আদালতে গাম্বিয়ার অভিযোগ করার আইনি বৈধতা নেই। এই ধারা অনুসারে মিয়ানমার উপসংহার টানে যে এই মামলায় আদালতের এখতিয়ার নেই।

৩৩. গাম্বিয়া দাবি করেছে যে গণহত্যা সনদের জ ধারায় সংরক্ষিত অধিকার অনুসারে মিয়ানমারের সংরক্ষণ প্রত্যাখ্যান করা উচিত।

৩৪. আদালত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে গণহত্যা সনদের ধারা জ–এ বলা হয়েছে, ‘এই ধারায় মিয়ানমারের সংরক্ষণ অনুসারে তা দেশটির ওপর প্রযোজ্য হবে না’।

৩৫. গণহত্যা সনদের ঝ ধারায় মিয়ানমার কোনো সংরক্ষণের আওতায় নেই। বর্তমান মামলায় এই ধারাই প্রযোজ্য।

৩৬. ওপরের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গণহত্যা সনদের জ ধারায় মিয়ানমারের সংরক্ষণ মূলত সনদের ঝ ধারার আওতায় বিবদমান বিষয়ে গাম্বিয়ার আদালতের দ্বারস্থ হওয়াকে ঠেকাতে পারে না।

. উপসংহার

৩৭. আদালত উপসংহারে পৌঁছেছেন যে গণহত্যা সনদের ঝ ধারা অনুসারে আদালতের এই মামলায় এখতিয়ার রয়েছে।

৩৮. উল্লিখিত উপসংহারের ভিত্তিতে আদালত মনে করেন যে এখতিয়ার না থাকার কারণে তালিকা থেকে মামলাটি অপসারণের বিষয়ে মিয়ানমারের আবেদনে আদালত সম্মত হতে পারেন না।

. গাম্বিয়ার অবস্থান

৩৯. মিয়ানমার মেনে নিয়েছে যে সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো মিয়ানমারের মেনে চলার ক্ষেত্রে গাম্বিয়ার স্বার্থ রয়েছে। যদিও গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়ার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সক্ষমতা নিয়ে মিয়ানমার দ্বিমত পোষণ করেছে। বিবাদীর যুক্তি, মিয়ানমারের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আক্রান্ত দেশ বাংলাদেশ।

৪০. গাম্বিয়ার যুক্তি, গণহত্যা সনদ অনুসারে এই সনদে স্বাক্ষরকারী যেকোনো রাষ্ট্রপক্ষ বিশেষ স্বার্থ প্রমাণ না করেই অন্য কোনো রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনতে পারে।

৪১. গণহত্যা সনদ পর্যবেক্ষণপূর্বক আদালত মনে করেন যে সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাষ্ট্রপক্ষেরই গণহত্যা প্রতিরোধের দায়দায়িত্ব ও সাধারণ স্বার্থ রয়েছে।

৪২. আদালত এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করার অবস্থান গাম্বিয়ার রয়েছে।

. যাদের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকার এবং এ ধরনের অধিকার ও অনুরোধকৃত পদক্ষেপের সম্পর্ক

৪৩. আদালত তখনই নিজের ক্ষমতার অনুশীলন করতে পারেন, যখন যাদের সুরক্ষা চাওয়া হয়, নির্দেশিত পদক্ষেপ তাদের জন্য সন্তোষজনক হয়।

৪৪. যাদের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকার এবং অনুরোধকৃত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের মধ্যে অবশ্যই একটি যোগসূত্র রয়েছে।

৪৫. আবেদনে গাম্বিয়া ‘গণহত্যা সনদের আওতায় সংরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সব সদস্যের’ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে।

৪৬. গাম্বিয়া দাবি করেছে যে আদালতে দাখিল করা প্রমাণাদি সাপেক্ষে প্রমাণিত হয়, তারা যেসব কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনেছে, সেগুলো অন্ততপক্ষে গণহত্যামূলক বলে প্রতীয়মান হয়।

৪৭. গাম্বিয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট জবাব দেয়নি মিয়ানমার। বিবাদী বরং দাবি করেছে যে যদি গাম্বিয়ার করা অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলেই কেবল গাম্বিয়া এই মামলা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে। মিয়ানমারের দাবি, গণহত্যা সনদের অধীনে ‘বিশ্বাসযোগ্য দাবি’র সঙ্গে অবশ্যই গণহত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত কর্মকাণ্ডের প্রমাণ সংযুক্ত করতে হবে।

৪৮. মিয়ানমার আদালতকে বলেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো গণহত্যার অভিপ্রায়ের অভিযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য গাম্বিয়া যথেষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে পারেনি।

৪৯. আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, গণহত্যার সনদের ধারা-ক অনুসারে, সব রাষ্ট্রপক্ষকে গণহত্যার অপরাধ ‘প্রতিরোধ ও সাজা’ নিশ্চিত করতে হবে। ধারা-খ অনুসারে, কোনো জাতি, জাতিগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠী আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংসের অভিপ্রায় গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে:

(ক) কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা

(খ) কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতরভাবে শারীরিক বা মানসিক আঘাত করা

(গ) কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা

(ঘ) কোনো জাতিগোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্দেশ্যমূলক পদক্ষেপ নেওয়া

(ঙ) একটি গোষ্ঠীর শিশুকে জোর করে অন্য একটি গোষ্ঠীর কাছে পাঠানো।

৫০. ধারা-গ অনুসারে গণহত্যা সনদের মধ্য দিয়ে গণহত্যা বন্ধ ছাড়াও নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলোও নিষিদ্ধ: গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রত্যক্ষভাবে এবং জনসাধারণকে গণহত্যার উসকানি, গণহত্যার পদক্ষেপ, গণহত্যায় সহায়তা।

৫১. গণহত্যা সনদের ধারা-ক-এ যে গণহত্যা ঠেকানো এবং শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আরও কয়েকটি ধারা পরিপূরক। সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ কার্যকরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে এই সনদের ঙ ও চ ধারায়।

৫২. জাতি, জাতিগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের রক্ষার লক্ষ্যে সনদের ধারাগুলো আবারও পর্যবেক্ষণ করেছেন আদালত। গণহত্যার সনদ অনুসারে কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের যে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, বিবদমান পক্ষগুলোর বাধ্যবাধকতা এবং বিবদমান পক্ষগুলোর অভিযোগের অধিকারগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, গণহত্যার সনদের ধারা-খ অনুসারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংরক্ষিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

৫৩. রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালে সংঘটিত কর্মকাণ্ড, যা ‘জাতিগত নিধন অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার উল্লেখ করে বর্তমানে মামলার শুনানিতে মিয়ানমার বলেছে, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা অযৌক্তিক বলপ্রয়োগ করেছে, অথবা তারা [আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা] সদস্য ও বেসামরিক লোকজনকে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করেনি’ এবং ‘লড়াই শেষে অথবা পরিত্যক্ত গ্রামে লুটতরাজ বা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে বেসামরিক লোকজনকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে।’

৫৪. ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশনের অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই অনুসন্ধানে বলা হয়, কাচিন, রাখাইন ও শান রাজ্যে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধের তদন্ত এবং বিচার করা যায়। এ ছাড়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

৫৫. ২০১৮ সালে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশন যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে, তা-ও আমলে নিয়েছেন আদালত। এই মিশন আরও তদন্তের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেখানে গণহত্যার অভিপ্রায়ের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি, যেখানে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘পরিকল্পিতভাবে দমন-পীড়ন’ চালানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এসব দমন-পীড়নের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের আইনি বৈধতা, পরিচয়, নাগরিকত্ব অস্বীকারের বিষয়সহ অনেক কিছু রয়েছে। আদালত এই প্রতিবেদন আমলে নিয়েছেন।

৫৬. অন্তর্বর্তী পদক্ষেপে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার যে আহ্বান জানিয়েছিল, তা আমলে নেননি আদালত। আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব ঘটনা এবং পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সুরক্ষা ও গণহত্যা থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষার পথ খুঁজছে গাম্বিয়া। মিয়ানমার এই গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

৫৭. এখন অভিযোগ করার অধিকার এবং অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ চাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করবেন আদালত।

৫৮. শুনানিতে গাম্বিয়া বেশ কয়েকটি অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ চেয়ে আবেদন করেছেন। এই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আবেদন বিবাদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে জড়িত। দেশটির পক্ষ থেকে প্রথম যে দুটি আবেদন করা হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য গাম্বিয়ার কাজ করার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে।

৫৯. গণহত্যা সনদ অনুসারে গাম্বিয়া যেসব অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ চেয়েছে, তার মধ্য ৫ ও ৬ নম্বর পদক্ষেপের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে মিয়ানমার।

৬০. আদালত ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছেন যে গণহত্যার সনদ অনুসারে গাম্বিয়া যে অধিকারের কথা বলছে, তা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত।

৬১. আদালত বিবেচনা করেছেন, গাম্বিয়া যে প্রথম তিনটি অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ চেয়েছে, তা মূলত গণহত্যা সনদের ভিত্তিতে, বিশেষত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার জন্য। ৪ ও ৫ নম্বর পদক্ষেপের আদেশ গাম্বিয়া চেয়েছে, বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে যেন বিতর্ক আরও না বাড়ে অথবা পরিস্থিতি আরও কঠিন যেন না হয় এবং বিবদমান পক্ষগুলোর তথ্য সরবরাহের জন্য।

৬২. ছয় নম্বর যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছে, আদালত মনে করছেন না, এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার দরকার আছে।

৬৩. আদালত এ উপসংহারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন যে অভিযোগ করার অধিকার এবং গাম্বিয়া যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ চেয়েছে, তার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।

. অসংশোধনযোগ্য বিদ্বেষের ঝুঁকি, দ্রুত পদক্ষেপ

৬৪. জাতিসংঘ সনদে আদালত প্রতিষ্ঠার ৪১ ধারা অনুসারে অন্তর্বর্তীমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

৬৫. অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা তখনই অনুশীলন করতে পারেন আদালত, যখন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে। আদালতকে অবশ্যই বিচারপ্রক্রিয়ার এ পর্যায়ে কোনো ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা নিরূপণ করতে হবে।

৬৬. গণহত্যা সনদ লঙ্ঘিত হয়েছে—এটা প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়নি। বরং এই সনদ অনুসারে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এটি নয়।

৬৭. গাম্বিয়া দাবি করেছে, রোহিঙ্গাদের অধিকার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গণহত্যার সনদ অনুসারেও তাদের অধিকার ঝুঁকিতে রয়েছে। গাম্বিয়ার দেওয়া তথ্য অনুসারে, রোহিঙ্গারা শুধু সাম্প্রতিক অতীতেই গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের স্বীকার হয়নি। তারা ভবিষ্যতেও এমন ঝুঁকির মুখে রয়েছে, যেহেতু মিয়ানমার সরকারের এখনো গণহত্যার অভিপ্রায় অব্যাহত রয়েছে।

৬৮. বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো বাস্তব ও আসন্ন ঝুঁকির কথা অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে প্রথম দাবি হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাজ করছে তারা। গণহত্যার চলমান কিংবা আসন্ন ঝুঁকি থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সমর্থন পাওয়া সম্ভব হতো না।

৬৯. এ জন্য ১৯৪৬ সালে ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে প্রস্তাব পাস হয়েছিল, সেটি আমলে নিয়েছেন আদালত।

৭০. যে মৌলিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের কথা গণহত্যা সনদে বলা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেছেন আদালত। বিশেষ করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার এবং এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সুরক্ষায় যে হুমকি রয়েছে, তা আমলে নেওয়া হয়েছে।

৭১. গণহত্যা সনদের আওতায় সুরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অধিকার ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে হুমকির মুখে রয়েছে বলে তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা আদালত আমলে নিয়েছেন। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে যে ৭ লাখ ৪৪ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বলে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা–ও আমলে নিয়েছেন আদালত।

৭২. আদালতের অভিমত হলো, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা ভয়ানক নাজুক।

৭৩. মিয়ানমার শুনানিতে বলেছিল, তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনছে। মিয়ানমারের এ বক্তব্য আমলে নিচ্ছেন আদালত।

আদালতের পর্যবেক্ষণ, যে পদক্ষেপগুলো মিয়ানমার নিয়েছে, তা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। এই জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য গাম্বিয়া যেসব পদক্ষেপের কথা বলেছে, তা বাস্তবায়নের প্রয়োজন হতে পারে।

গণহত্যার সনদ অনুসারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করেনি মিয়ানমার। আদালত এ বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। এর চেয়ে বড় কথা হলো, রাখাইনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না—এ নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যে হতাশা প্রকাশ করেছে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর, তা আদালত উপেক্ষা করতে পারেন না।

৭৪. চূড়ান্তভাবে আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, রাখাইনে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষসহ নানাবিধ পরিস্থিতি হয়তো মিয়ানমারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ সত্ত্বেও গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে হবে মিয়ানমারকে।

৭৫. আদালত অনুধাবন করতে পেরেছেন যে গাম্বিয়ার আবেদনে উল্লিখিত আসন্ন ও গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গারা, যা আদালত চিহ্নিত করেছেন।

. উপসংহার এবং যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে ৭৬. ওপরের সব যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে আদালত উপসংহারে পৌঁছেছেন যে জাতিসংঘ সনদে আদালত প্রতিষ্ঠার ধারাগুলোর আওতায় অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।

৭৭. জাতিসংঘ সনদে আদালত প্রতিষ্ঠার ধারাগুলো অনুসারে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের অনুরোধ সাপেক্ষে আদালতের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। অতীতে এ ক্ষমতার অনুশীলন আদালত করেছেন।

৭৮. বর্তমান মামলায় গাম্বিয়ার অনুরোধকৃত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আবেদন এবং মামলার পরিস্থিতি বিবেচনায় আদালত অনুধাবন করেছেন যে অনুরোধকৃত পদক্ষেপ ও আদেশকৃত পদক্ষেপ এক রকম না হলেও চলবে।

৭৯. গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো মানার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের দায়দায়িত্ব বিবেচনায় রেখে আদালত মনে করেন, সনদের খ ধারা অনুসারে নিজের ক্ষমতাবলে মিয়ানমার যেকোনো প্রকার কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। বিশেষ করে, (ক) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা; (খ) এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতরভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন; (গ) এই জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কিংবা আংশিক ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় যেকোনো প্রকার পদক্ষেপে ইচ্ছাকৃত উসকানি; এবং (ঘ) এই জনগোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্দেশ্যমূলক পদক্ষেপ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৮০. মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী, অনিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্য যেকোনো সংস্থা ও ব্যক্তি যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড, গণহত্যা চালাতে ষড়যন্ত্র, গণহত্যা সংঘটনে উসকানি ও নির্দেশ, গণহত্যা চালানোর চেষ্টা, অথবা গণহত্যায় সহায়তা না করে, তা মিয়ানমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

৮১. গণহত্যা সনদের খ ধারায় বর্ণিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ সম্পর্কিত যেকোনো প্রকার প্রমাণাদি সংরক্ষণ এবং এগুলো ধ্বংস করা প্রতিরোধে মিয়ানমারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৮২. এই আদেশ জারির চার মাস পর মিয়ানমারকে অবশ্যই আদেশকৃত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে গৃহীত সব পদক্ষেপের বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। এবং এরপর আদালতের চূড়ান্ত আদেশ না আসা পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পর মিয়ানমারকে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়ে যেতে হবে। প্রতিটা প্রতিবেদন গাম্বিয়াকে সরবরাহ করা হবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি আদালতে নিজের মন্তব্য দাখিল করতে পারবে।

৮৩. বিবদমান পক্ষগুলোর (গাম্বিয়া ও মিয়ানমার) মধ্যে বিবাদ যাতে না বাড়ে, সে জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপের আদেশ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা পাননি আদালত, যদিও গাম্বিয়া এ ধরনের পদক্ষেপের আদেশ চেয়েছিল।

৮৪. আদালত জোরের সঙ্গে আবারও বলছেন যে বিবাদীপক্ষের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।

৮৫. আদালতের এখতিয়ারের প্রশ্নে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের সরকারের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও প্রমাণাদি হাজির করার অধিকার অব্যাহত থাকবে।

৮৬. অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ:

. সর্বসম্মতিক্রমে

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে গণহত্যা সনদ অনুসারে দেশটি নিজ ক্ষমতাবলে সব ধরনের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেবে, বিশেষত:

ক. এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা;

খ. এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতরভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন;

(গ) এই জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কিংবা আংশিক ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় যেকোনো প্রকার পদক্ষেপে ইচ্ছাকৃত উসকানি;

এবং (ঘ) এই জনগোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্দেশ্যমূলক পদক্ষেপ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে;

. সর্বসম্মতিক্রমে

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী, অনিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্য যেকোনো সংস্থা ও ব্যক্তি যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড, গণহত্যা চালাতে ষড়যন্ত্র, গণহত্যা সংঘটনে উসকানি ও নির্দেশ, গণহত্যা চালানোর চেষ্টা, অথবা গণহত্যায় সহায়তা না করে, তা মিয়ানমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে;

. সর্বসম্মতিক্রমে

গণহত্যা সনদের খ ধারায় বর্ণিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ–সম্পর্কিত যেকোনো প্রকার প্রমাণাদি সংরক্ষণ এবং এগুলো ধ্বংস করা প্রতিরোধে মিয়ানমারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে;

. সর্বসম্মতিক্রমে

এই আদেশ জারির তারিখ থেকে চার মাসের মধ্যে মিয়ানমারকে অবশ্যই আদেশকৃত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে গৃহীত সব পদক্ষেপের বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। এবং এরপর আদালতের চূড়ান্ত আদেশ না আসা পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পর মিয়ানমারকে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়ে যেতে হবে।

অনুবাদ: রাজিউল হাসান ও মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল