ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি শুধু কাগজেই

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের সমাবেশে স্কুলশিক্ষার্থীরা। গতকাল নদ্দার কালাচাঁদপুর সরকারি স্কুল প্রাঙ্গণে।  ছবি: সাজিদ হোসেন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের সমাবেশে স্কুলশিক্ষার্থীরা। গতকাল নদ্দার কালাচাঁদপুর সরকারি স্কুল প্রাঙ্গণে। ছবি: সাজিদ হোসেন

বাংলাদেশে নির্বাচনকে উৎসবে রূপ দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। তবে উৎসব যাতে লাগামছাড়া না হয়, সে জন্যই আচরণবিধির খড়্গ দিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সেই আচরণবিধি নিয়ে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা ও ট্রাকে শব্দযন্ত্র বসিয়ে দিনভর উচ্চ শব্দে গানের তালে ভোট চাওয়ার বিষয়টি অনেকের কাছেই এখন ‘আপদ’ ঠেকছে। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জন্য তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপাসনালয়, হাসপাতাল ও বিদ্যালয়—কিছুই মানছে না এই প্রচারযন্ত্রগুলো।

গতকাল শনিবার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তত ১৫টি স্থানে সকাল থেকেই মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের পক্ষে মাইকে প্রচার চালাতে এবং গানে গানে ভোট চাইতে দেখা গেছে। রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা ও ছোট ট্রাকে শব্দযন্ত্র বসিয়ে রেকর্ড করা প্রচারে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। গভীর রাত পর্যন্ত চারদিকে কান পাতলে ভেসে আসছে, ‘...ভাইয়ের দুই নয়ন, এলাকাবাসীর উন্নয়ন। জিতবে এবার...।’ এর বাইরে আছে জনপ্রিয় বিভিন্ন গানের প্যারোডি। গতকাল এ ধরনের উচ্চ শব্দের প্রচার দেখা গেছে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, কমলাপুর, সূত্রাপুর, বংশাল, মালিবাগ ও ধানমন্ডি এলাকায়। উত্তর সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, রামপুরাসহ প্রায় সব এলাকায় একই প্রচার দেখা গেছে।

গতকাল সকাল থেকে কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কালাচাঁদপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের একমাত্র মাঠে প্যান্ডেল টানিয়ে ও মঞ্চ করে ঢাকা উত্তর সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা যায়। সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে বেশির ভাগ ক্লাস ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। শব্দযন্ত্রের সাহায্যে ‘জয় বাংলা, জিতবে এবার নৌকা’ স্লোগান–সংবলিত গান বাজানো হয়। এ সময় স্কুলড্রেস পরা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের গানের তালে তালে নাচতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীসহ অন্যদের হাতে ছিল আতিকুল ইসলামের প্রচারপত্র। অবশ্য সেখানে প্রার্থী আতিকুল ছিলেন না।

স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্কুল মাঠে নির্বাচনী সমাবেশের জন্য কেউ অনুমতি নেয়নি। তারা ১১টার দিকে দ্বিতীয় তলায় শিক্ষক মিলনায়তনে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে সভায় বসেছিলেন। কিন্তু সমাবেশ ও উচ্চ স্বরে নির্বাচনী গান বাজতে থাকায় সেখানে পাশাপাশি দুজনের কথা শুনতে বেগ পেতে হচ্ছিল।

>

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন। প্রচারযন্ত্রের উচ্চ শব্দ যেন ‘আপদ’। পথসভা না হলেও কর্মী-সমর্থকদের মিছিল সড়কে চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।

সপ্তম ও নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী জানায়, ভোটের প্রচারের কারণে সাড়ে ১০টার দিকে তিনটি ক্লাসের পর তাদের ছুটি হয়ে যায়। আরেক শিক্ষার্থী জানায়, তার বাসা উত্তর বাড্ডায়। দুপুর সাড়ে ১২টায় ছুটি হলে তার মা এসে নিয়ে যান। গতকাল আগে ছুটি হওয়ায় সে সমস্যায় পড়ে যায়।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণবিধিমালা অনুযায়ী, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনো দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি ওয়ার্ডে পথসভা বা নির্বাচনী প্রচারণার কাজে একটির বেশি মাইক্রোফোন বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন না। বেলা দুইটার আগে এবং রাত আটটার পরে মাইক বা শব্দযন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ।

এসব প্রচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রার্থীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন গান ও প্রচার রেকর্ড করে সরবরাহ করা হয়েছে। তাঁরা ঘণ্টা হিসেবে টাকা পেয়ে থাকেন। সারাক্ষণই শব্দযন্ত্র চালু রাখেন তাঁরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা উপাসনালয় দেখলে শব্দযন্ত্র বন্ধ রাখার কথা কেউ তাঁদের বলে দেননি।

মিরপুর–২ বড়বাগ এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁর মেয়ে নুসরাত জাহান হকের এসএসসি পরীক্ষা। ভোটের কারণে এক দফা পরীক্ষা পিছিয়েছে। বিকট শব্দে নির্বাচনী প্রচারের কারণে এখন পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত ঘটছে। সকাল থেকে রাত ১২টার পরও উচ্চ শব্দের প্রচার চলে বলে তিনি জানান।

শক্তি বোঝাতে বিধি লঙ্ঘন
আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচন–পূর্ব সময়ে কোনো ধরনের মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। পথসভা বা ঘরোয়া সভা করতে চাইলে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা আগে স্থান ও সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশকে জানাতে হবে। যাতে ওই জায়গায় চলাচল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার মেয়র পদপ্রার্থী প্রতিদিনই নির্বাচনী প্রচারে নামছেন কয়েক শ কর্মী–সমর্থক নিয়ে। আনুষ্ঠানিক পথসভা না করলেও তাঁরা মিছিল-স্লোগানে মাতিয়ে রাখছেন। প্রার্থীরা যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই সড়কে চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল গতকাল দুপুরে পল্লবী, মিরপুর–৬ ও ভাষানটেকে প্রচার চালান। এ সময় তাঁর সঙ্গে কয়েক শ নেতা–কর্মী যুক্ত হন। তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। শব্দযন্ত্রে বিকট আওয়াজে প্রচার চালানো হয় এ সময়, যা শোডাউনের পর্যায়ে পড়ে। এ সময় সড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য মাইকে একটি করে গাড়ি চলাচলের মতো জায়গা রাখতে পুলিশ ও কর্মীদের নির্দেশনা দিতে শোনা যায়। তবে কেউ এই নির্দেশনা মানছিল না।

 উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম দুপুরে কালাচাঁদপুর মোড়ে ভোট চেয়ে বক্তৃতা করেন। কয়েক শ কর্মী-সমর্থক জড়ো হলে সড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার আতিকুল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পাশের মাঠে প্রচার চালান। সেখানে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্সকে উপস্থিত হয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে এবং স্লোগান দিতে দেখা যায়।

ঢাকা দক্ষিণে দুপুর ১২টা থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করার কথা ছিল শেখ ফজলে নূর তাপসের। তাই সকাল থেকেই বাবুবাজার সেতুর নিচে জড়ো হন স্থানীয় নেতা–কর্মীরা। সরু রাস্তায় নেতা–কর্মীদের অবস্থানের কারণে তৈরি হয় যানজট। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে পৌঁছান তাপস। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠনের নেতা–কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে নৌকার প্রার্থীকে ফুল ছিটিয়ে অভ্যর্থনা জানান।

বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন গতকাল প্রচার চালান রায়সাহেব বাজার, গোয়ালনগর লেন, তাঁতীবাজার মোড়সহ নানা স্থানে। এ সময় কয়েক শ নেতা–কর্মী তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলে একধরনের জটলা তৈরি হয়। বিএনপির কর্মী–সমর্থকেরা জানান, প্রচারের শুরু থেকেই তাঁরা এভাবে নিজেদের শক্তি–মত্তা দেখানোর জন্য বড় জমায়েত করছেন।

ইসি কী করছে
উত্তর সিটিতে ৫৪টি ও দক্ষিণ সিটিতে ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ড রয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই সিটির চারটি ওয়ার্ডে বিএনপি প্রার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া উত্তরে অন্তত ১৫টি ও দক্ষিণে ২৩টি ওয়ার্ডে বিএনপি প্রার্থীদের পোস্টার ছেঁড়া ও প্রচারণার কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে।

তফসিল ঘোষণার পরপরই আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগের প্রতিকারের জন্য দুই সিটিতে ৪৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর গাবতলী এলাকায় হামলার অভিযোগ ওঠে। এর বিচার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট করবেন, নাকি পুলিশ ব্যবস্থা নেবে—এ নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে। পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার লাগানো যাবে কি না, এ নিয়ে উচ্চ আদালতকে নির্দেশনা দিতে হয়েছে। এরপরও কেউ মানছেন না। প্রায় সব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছেন ঢাকার অলিগলি।

কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। এ ছাড়া ইসিকে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও দেওয়া আছে।

কিন্তু এ বিষয়ে কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ইসিতেই প্রশ্ন আছে। গত ২০ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) চিঠি দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা না নিলে কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট নিরসন সম্ভব হবে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত ৪২টি অভিযোগের ৪০টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে জরিমানা করা হয়েছে। অনেককে সতর্ক করা হয়েছে। এক প্রার্থী এক ওয়ার্ডে একাধিক মাইক ব্যবহার করায় বাড়তি মাইক নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়েছে। এটি কমিশনে পাঠানো হয়েছে। আরেকটি অভিযোগের তদন্ত চলছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ৬২টি অভিযোগ পেয়েছেন। সব কটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে সতর্ক করা হয়েছে। অনেককে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আর্থিক জরিমানা করা হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সারা দিন উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হচ্ছে। লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে, শব্দদূষণও হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। ছোটখাটো অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে বড় অপরাধ ও সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি হয়। কাউন্সিলর প্রার্থীরা যেকোনো মূল্যে জিততে মরিয়া। এর বাইরে আছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। ফলে শঙ্কা দূর করার জন্য কমিশনের তৎপর হওয়ার বিকল্প নেই।